বিক্ষোভে উত্তাল মিয়ানমার

আবারও রক্তাক্ত রাজপথ ঝরল আরও এক প্রাণ

জাতিসংঘে দেশটির রাষ্ট্রদূতের জান্তাবিরোধী অবস্থান

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভে উত্তাল মিয়ানমারে পুলিশের গুলিতে আবারও রক্তাক্ত হয়েছে দেশটির রাজপথ। প্রাণ গেছে আরও এক বিক্ষোভকারীর। জাতিসংঘে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত অভু্যত্থানকারীদের থামাতে 'যেকোনো ব্যবস্থা' নেওয়ার আহ্বান জানানোর পর শনিবার পুলিশের গুলিতে একজন নারী বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। সংবাদসূত্র : রয়টার্স, বিবিসি গত ১ ফেব্রম্নয়ারি সামরিক বাহিনী অভু্যত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে মিয়ানমার। অভু্যত্থানের পর দেশটির নির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতাকর্মীদের আটক করে জান্তাবাহিনী। গত নভেম্বরে দেশটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে 'জালিয়াতির' মাধ্যমে এনএলডি জয়ী হয়েছে বলে অভিযোগ করে অভু্যত্থানের পক্ষে সাফাই গাইছে তারা। স্থানীয় তিনটি গণমাধ্যম বলছে, শনিবার মনওয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে একজন নারী নিহত হয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে এই শহরে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া একজন বলেন, এ দিন বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে জলকামান ছুড়েছে পুলিশ। মনওয়ার বাসিন্দা আয়ে আয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে জলকামান ও গুলি ব্যবহার করেছে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের এ ধরনের আচরণ করা উচিত নয়। অন্যদিকে, ইয়াঙ্গুনে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে লোকজন শনিবারও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তারা জান্তাবিরোধী বিভিন্ন ধরনের সেস্নাগান ও গান গেয়ে শহরের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয়। এদিকে, মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেছেন, কর্তৃপক্ষ সর্বনিম্ন বলপ্রয়োগ করছে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভে পুলিশি সহিংসতায় দেশটিতে এ নিয়ে চার বিক্ষোভকারীর প্রাণহানি ঘটল। এছাড়া সহিংসতায় পুলিশের এক সদস্যও নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। এর আগে জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিয়াও মোয়ে তুন তার দেশে সামরিক অভু্যত্থানকারীদের থামাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ দমনে পুলিশের কঠোর অবস্থানের মধ্যে শুক্রবার তার এ আহ্বান জান্তার ওপর চাপ আরও বাড়াবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মোয়ে তুন শুক্রবার সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এবং দেশটির জনগণের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানান। বার্মিজ ভাষায় শেষ কথাগুলো বলে মোয়ে তুন হাতের তিন আঙুল দেখিয়ে অভু্যত্থানবিরোধীদের চিহ্নে পরিণত হওয়া 'থ্রি ফিঙ্গার স্যালুট' দেন। তিনি বলেন, 'আমাদের চাওয়াই বিজয়ী হবে'। জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির সামরিক বাহিনীর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সাধারণ পরিষদে বক্তব্য দিয়ে মোয়ে তুন এরই মধ্যে বিক্ষোভকারীদের কাছে 'নায়কে' পরিণত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ভেসে যাচ্ছে একের পর এক প্রশংসা বার্তায়। 'জনগণ জিতবে আর ক্ষমতালোভী জান্তা হারবে'- ফেসবুকে এমনটাই লিখেছেন বিক্ষোভকারীদের অন্যতম নেতা ই থিনজার মং। মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিনা শানার সাধারণ পরিষদকে 'গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থনের সম্মিলিত ও স্পষ্ট সংকেত' দিতে এবং কোনো দেশ যেন মিয়ানমারের জান্তাকে স্বীকৃতি না দেয়, তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। এছাড়া চীনের দূত অভু্যত্থানের সমালোচনা না করে মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে দেশটির 'অভ্যন্তরীণ ব্যাপার' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সংকট সমাধানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট 'আসিয়ান' যে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে, তার প্রতি বেইজিংয়ের সমর্থনের কথাও জানিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীদের শঙ্কা, আসিয়ানের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তা দেশটির ক্ষমতাসীন জেনারেলদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। সিঙ্গাপুর মিয়ানমারে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে 'অমার্জনীয়' আখ্যা দিয়েছে। এদিকে, দেশটির নেত্রী অং সান সু চি এখন কোথায় আছেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম 'মিয়ানমার নাউ' শুক্রবার এনএলডির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলেছে, চলতি সপ্তাহে সু চিকে গৃহবন্দি থেকে অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেশটিতে অভু্যত্থানের পর লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে; যা অব্যাহত রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারে সামরিক অভু্যত্থানের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বেশকিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ত্রাস হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের পুলিশ জাতিসংঘে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের দূত সরব হয়ে ওঠার পর দেশটির সেনা অভু্যত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে ত্রাস হয়ে উঠেছে পুলিশ। শনিবার বিক্ষোভকারীরা সমবেত হওয়ার আগেই কয়েকটি জায়গার দখল নিয়ে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সমবেত হওয়ার চেষ্টা করলেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বিক্ষোভকারীদের। লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ছুড়ে ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তাদের। আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীকেও। জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূতের তৎপরতার পরই বিক্ষোভ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে মিয়ানমারের পুলিশ। বন্দরনগরী ইয়াঙ্গুনসহ যেসব স্থানে সাধারণত বিক্ষোভকারীরা সমবেত হয়ে থাকে, শনিবার সকাল থেকেই সেসব স্থানের দখল নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সমবেত হওয়ার চেষ্টা করলেই বিক্ষোভকারীদের আটক করা হচ্ছে। তারপরও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে বিক্ষোভকারীরা। ইয়াঙ্গুনের সড়কে বিক্ষোভ করে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদেরও একটি গোষ্ঠী। দিন গড়াতে থাকলে তাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। অভু্যত্থানবিরোধী গান গেয়ে বিভিন্ন সড়কে মিছিল শুরু করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং ফাঁকা গুলি বর্ষণ করা হয় বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।