বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
উত্তাল মার্চ

অন্তর্নিহিত শক্তির উৎসের মাস শুরু

যাযাদি রিপোর্ট
  ০১ মার্চ ২০২১, ০০:০০

শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতা, গৌরবগাথা ও অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস মাস মার্চ। এটি অগ্নিঝরা ইতিহাস, বিষাদ ও বেদনার মাস। এই মাসের ২৫ তারিখ থেকে লেখা শুরু হয়েছিল এক অমর মহাকাব্য, যার নাম বাংলাদেশ। বাঙালির জীবনে ভাষা আন্দোলনের স্মারক মাস ফেব্রম্নয়ারির পর মার্চের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয় এই মার্চেই। স্বাধীনতার ৫০ বছরের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের মার্চ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

এই মাসেই বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। উত্তাল একাত্তরে মার্চ মাসজুড়ে বাঙালির চোখে ছিল

স্বাধীনতার স্বপ্ন।

আজকের এই দিনে অর্থাৎ ১ মার্চ, ১৯৭১ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের সাধারণ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তে গর্জে ওঠে পুরো দেশ। পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষ স্স্নোগান তুলে 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। মার্চ মাসেই বাঙালি জাতি তার চেতনাকে নতুন করে শাণিত করে। নতুন শপথে বলীয়ান হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই জাতিকে নতুন করে পথ দেখায়।

একাত্তরের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শোষিত ও ক্ষুব্ধ জনগণ ন্যায়সঙ্গত ও প্রাপ্য অধিকার প্রশ্নে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। এ ভূখন্ড হয়ে ওঠে আন্দোলনমুখর, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি।

৩ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) কমনওয়েলথের উদ্যোগে পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা খেলা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ততক্ষণে হাজার হাজার মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দেন। এ সময় তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বিশাল মিছিল ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে মতিঝিল পূর্বাণী হোটেলের সামনে উপস্থিত হয়। এদিন পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক চলছিল। মিটিং থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' স্স্নোগানে মুখর করে তোলে গোটা এলাকা।

আর কোনো আলোচনা নয়, এবার পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে দাবি তুলে ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার অনুরোধ জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন এবং পরদিন ২ মার্চ হরতাল ডাকলেন। ঘোষণা দিলেন ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচি জানানোর।

তার এ ঘোষণার পর অচল হয়ে পড়ে দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন দিন দিন তীব্র হয়ে ওঠে। মূলত ১ মার্চ দুপুর থেকেই সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এদিন বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায়র্ যালির কর্মসূচি ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ ঢাকা ইউনিটের। নির্ধারিত সময় যাতে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে এবং 'সকল ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিয়ে যাতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের আছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়' সেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতেই তাদের এইর্ যালি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয় আগের দিন সন্ধ্যায় পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে।

বটতলায় ছাত্র সংঘের মিছিলটি হয়েছিল কি না জানা যায়নি, তবে ওই একই জায়গা (বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা) থেকে একই সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক মিটিং শেষে মিছিল বের হয় যারা সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করা হয়। তবে টিএন্ডটি কর্মচারীরা জাতীয় স্বার্থে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়।

ঢাকার আশপাশের এলাকায়ও এদিন নামে মিছিলের ঢল। সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ক্লাস বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। খুলনা শহীদ মিনার এবং যশোরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হয় প্রতিবাদী জনতা।

ঢাকা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে মিছিল বের করে আইনজীবীরা বায়তুল মোকাররমে সভা করে ইয়াহিয়ার ঘোষণার প্রতিবাদ জানায়। ইয়াহিয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিল মুসলিম লীগের একাংশের প্রধান খান আবদুল কাইয়ুম। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে দল থেকে পদত্যাগ করেন সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুর। তিনি দলের সদস্যপদ থেকেও অব্যাহতি নেন।

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান নুরুল আমিন এক বিবৃতিতে ইয়াহিয়ার গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণার নিন্দা করে বলেন, 'রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় আমি হতভম্ব হয়ে গেছি'। একই প্রতিক্রিয়া জানান পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান। অলি আহাদ, শফিকুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন প্রধান মতিয়া চৌধুরীও একই রকম বিবৃতি পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানান।

লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' শীর্ষক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পরপরই ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের সব শহরেই উত্তাল জনতা ক্রোধে ফেটে পড়ল। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কলকারখানার শ্রমিক এবং আদালতের আইনজীবী ও সর্বস্তরের জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসেন। ১৯৬৯ সালের গণ অভু্যত্থানের মতো গোটা শহর স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আসাদ চৌধুরীর 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' শীর্ষক গ্রন্থে উলেস্নখ করা হয়- 'পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানকে সরিয়ে সামরিক প্রশাসন লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে গভর্নরের দায়িত্ব প্রদান করেন। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে প্রতিক্রিয়া হয় দ্রম্নত। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে।

উত্তাল মার্চের শেষের দিকে শুরু হয়ে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বের বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা। এ মাসেই জাতি এবার পালন করছে মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর। এ উপলক্ষে মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হবে সভা সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিকসহ নানা আয়োজন। সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে বছরব্যাপী মুখরিত থাকবে গোটা দেশ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে