টিকাদানে গতি বাড়াতে নতুন কর্মপরিকল্পনা

প্রকাশ | ০২ মার্চ ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
১১ বার চেষ্টার পর গত ২৪ ফেব্রম্নয়ারি করোনা টিকা নেওয়ার জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিজের নাম নিবন্ধন করতে সক্ষম হয়েছেন সবুজবাগের ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা হালিমা খাতুন। তবে রোববার পর্যন্ত তিনি তার মোবাইল ফোনে টিকাগ্রহণের তারিখ জানানো কোনো খুদে বার্তা পাননি। সশরীরে নির্ধারিত কেন্দ্রে গিয়ে টিকাগ্রহণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এ অবস্থায় টিকা নেওয়ার ব্যাপারে তার আগ্রহ দিন দিন কমতে শুরু করেছে। নিবন্ধনের এক সপ্তাহ পরও টিকা নেওয়ার খুদে বার্তা না আসায় ভীষণভাবে হতাশ রামপুরার পঞ্চাশোর্ধ্ব নজরুল ইসলাম। কেননা, জরুরি কাজে তাকে সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে। অথচ টিকাগ্রহণের দিনক্ষণ না জানায় তিনি এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা করতে পারছেন না। এ অবস্থায় টিকা নেওয়ার জন্য তিনি আরও কিছু দিন অপেক্ষা করবেন, নাকি টিকাগ্রহণের সিদ্ধান্ত বাতিল করবেন, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। শুধু ঢাকা মহানগরই নয়, দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের বিপুলসংখ্যক মানুষ নিজের নাম সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন টিকাগ্রহণের খুদে বার্তা পাওয়ার আশায়। তবে কাঙ্ক্ষিত সেই বার্তা না পেয়ে অনেকেই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এদিকে টিকাদান কেন্দ্রগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, যে সংখ্যক টিকা দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুতি নিয়েছেন, প্রতিদিনই এর প্রায় দুই-তিন গুণ মানুষ টিকা নেওয়ার জন্য ভিড় করছেন। ফলে করোনা টিকাদানে প্রশিক্ষিত নার্সসহ অন্যরা রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছেন। অন্যদিকে গত ৭ জানুয়ারি থেকে গণ-টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ২৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত মোট ২২ দিনে ঢাকাসহ সারাদেশে মাত্র ৩১ লাখ ১০ হাজার ৫২৫ জনকে এর আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। অথচ দেশে ১৩ কোটি ৭৬ লাখ মানুষকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার টার্গেট রয়েছে। অর্থাৎ দুই ডোজ হিসাবে ২৭ কোটি ৫২ লাখ টিকা দিতে হবে। এই হিসাবে এখন পর্যন্ত মাত্র ১ দশমিক ১৩ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই গতিতে টিকাদান কর্মসূচি এগুলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লাগবে। আর এতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এ অবস্থায় টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়াতে সরকার নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এই কাজে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ঝুঁকিহীনভাবে সম্পৃক্ত করা যায় কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। টিকাগ্রহণে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করতে গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বেশকিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করা হতে পারে। ঢাকা মহানগরীসহ দেশের প্রতিটি টিকাদান কেন্দ্রের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর ভিত্তি করে টিকার সরবরাহ আরও বাড়ানো হবে। এছাড়া টিকাদান কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নতুন ও পুরনো কেন্দ্রগুলোতে যাতে প্রতিদিন আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যায়, এ জন্য প্রশিক্ষিত নার্সসহ অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো হচ্ছে। শুক্রবারসহ অন্যান্য ছুটির দিন টিকা দেওয়া যায় কিনা, তা-ও তারা খতিয়ে দেখছে। অন্যদিকে করোনা টিকা নিতে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা রয়েছে, তা দ্রম্নত কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিতে যারা পিছিয়ে, তাদের নিবন্ধন কীভাবে সহজ করা যায়, এর পথ খোঁজা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সরকার নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, টিকাদান কর্মসূচির গতি বাড়ানো যেমন জরুরি, তেমনি এ ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহী করে তোলা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাদের ভাষ্য, টিকাগ্রহণে নাম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া জটিল। এর যথাযথ প্রচারও নেই। নিবন্ধন করতে গিয়ে জটিলতায় পড়ে কেউ যাতে টিকাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, নিবন্ধন প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানো, প্রচার বাড়ানো এবং টিকাদান কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা- এই তিন বিষয়ে দ্রম্নত সমাধানে না পৌঁছলে করোনা টিকা কার্যক্রম খুব একটা সুফল বয়ে আনবে না। তিনি বলেন, 'ফলাও করে প্রচার করা হলেও অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন হবে। অথচ নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরও বাস্তবসম্মত উপায় বেছে নেওয়া দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সহকারী, সিএসসিপি, পরিবার কল্যাণ সহকারী, এনজিওকর্মীরা রয়েছেন। তাদের নিবন্ধন কাজে যুক্ত করা যেত।' এদিকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমএ মুবিন বলেন, 'সারাদেশে করোনা টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু এতে বেসরকারি হাসপাতালের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ স্বাস্থ্য খাতে তাদের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে টিকাদান কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করা হলে এর গতি কয়েকগুণ বাড়বে।' এমএ মুবিন জানান, 'তারা সরকারকে দুটি প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রথমত, তারা এই টিকা বিনামূল্যে চেয়েছেন। আর তা না হলে সরকার যে দাম ঠিক করে দেবে, সেই দামে তারা কিনে নেবেন। ফ্রি পেলে তারা বিনামূল্যেই এই টিকা দেবেন। আর দাম দিয়ে কিনলে সামান্য লাভ রেখে তারা এই টিকা দেবেন।' প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সভাপতি ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, 'আমরা টিকা চাই। সরকার সেটা টাকার বিনিময়ে দিলেও আমরা নেব। অনেক সামর্থ্যবান আছেন, যারা টিকা কিনে নিতে চান। সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নাম নিবন্ধন করে টিকা নেওয়ার সময়ের খুদে বার্তা পাওয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা এবং লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে টিকা নিতে অনেকেই ততটা আগ্রহী নন। তাই এ শ্রেণির মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে প্রাইভেট খাতকে অবহেলা করা ঠিক না।' তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বেসরকারি খাতে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয় ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার ততটা আগ্রহী নয়। কেননা, তাদের নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।