রাজধানী এখন মশার স্বর্গরাজ্য

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে মশক নিধনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এতে তেমন সুফল মিলছে না

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

ফয়সাল খান
'মশা, মশা; করি কী?' মশা নিধনের স্প্রের এমন একটি বিজ্ঞাপন সবার নজর কেড়েছিল। সেসময় ওই বিজ্ঞাপনের কারণে মশা নিধনের স্প্রেটি ব্যাপকভাবে বিক্রি হতো। প্রায় দেড় যুগ পরে এখন নগরবাসী প্রায় সবার মুখে শোনা যায় ওই বিজ্ঞাপনের জনপ্রিয় কথাটি 'মশা, মশা; করি কী?' এখন আর স্প্রে, কয়েল বা দেশি-বিদেশি ওষুধ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের সব আয়োজন, সব ওষুধকে 'তুচ্ছাতিতুচ্ছ' করে মশারা দলবেঁধে তাদের পোঁ-পোঁ ধ্বনিতে নগরবাসীকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। দিন নেই, রাত নেই, সকাল-দুপুর-সাঁঝ নেই; মশার যন্ত্রণায় নগরবাসী খাবি খাচ্ছে। অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় মশার দাপট বেশি। ঢাকাকে এখন মশার স্বর্গরাজ্য হিসেবেও অভিহিত করছেন কেউ কেউ। মশার উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মশারি, কয়েল আর স্প্রে-ই নগরবাসীর শেষ ভরসা। তবুও পুরোপুরি সংকট নিরসন হচ্ছে না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে মশক নিধনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এতে তেমন সুফল মিলছে না। সম্প্রতি এডিস মশা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কিউলেক্স মশার গুনগুন শব্দ আর কামড় নগরজুড়ে মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এডিস মশার মতো ভয়াবহ না হলেও এ মশার কামড়ে অনেক সময় গোদরোগ হয়। এটি হলে হাত-পা ফুলে শরীরের বিভিন্ন অংশ বড় হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, যেকোনো উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখনই মশা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। এমনকি অতীতের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশা নিধনে জোর তৎপরতা চালানোর দাবি করা হয়েছে। বেশ কয়েকবার মশার ওষুধও পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এতে কার্যকর ফল আসেনি। ফলে আবারও কিউলেক্স মশার জন্য নতুন ওষুধ আনছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চলতি মাসের মাঝামাঝি যার প্রয়োগ শুরু হতে পারে। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশা নিধনে এবার ড্রোন ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। এরই মধ্যে এ পদ্ধতির পরিক্ষামূলক ব্যবহারও শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানী লেকে ড্রোনের সাহায্যে মশা নিয়ন্ত্রণের এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে বনানী লেকের আশপাশ এলাকায় ফলোআপ করেছি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এই সিস্টেমটি কাজে আসছে। এখন আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। শিগগিরই যেসব স্থানে মশা নিয়ন্ত্রণকর্মীরা ওষুধ \হছিটাতে পারছেন না সেসব স্থানে ড্রোন কাজ করবে। ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জলাশয় থেকে মশার বিস্তার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব জলাশয়ে সনাতন পদ্ধতিতে ওষুধ ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না, সেসব জায়গায় ড্রোনের সাহায্যে কীটনাশক ছিটানো হবে। দেশে তৈরি ড্রোন দিয়ে প্রতি মিনিটে ৫ লিটার ওষুধ ছিটানো সম্ভব হবে। এই উদ্যোগ সফল হলে অল্প সময়ে মশা নিধন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে রাজধানীর মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। প্রতি বছরের এ সময় মশার আধিক্য দেখা যায়। এরপরও এবার অস্বাভাবিক হারে মশা বৃদ্ধির দায় সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না। সময়মতো কার্যকর ওষুধ না ছিটানোয় মশার বিস্তার বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রায় সব এলাকায়ই মশার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভিআইপি এলাকা থেকে শুরু করে বস্তিতেও মশার আধিপত্য। সিটি করপোরেশন যেসব ওষুধ প্রয়োগ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। করপোরেশন যে ওষুধ ছিটাচ্ছে, এতে মশা নিধন হচ্ছে না, বরং বায়ুদূষণ হচ্ছে। ফগার মেশিন দিয়ে শুধু বিভিন্ন এলাকায় ধোঁয়া সৃষ্টি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। এর কোনো কার্যকর ফল মিলছে না। নগরবাসী বলছে, 'মশা নিধনে সিটি করপোরেশন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয় না। লোক দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায়। ধোঁয়া শেষ হলে আবার মশা উড়তে শুরু করে। অনেকেই আবার মশককর্মীদের দেখাও পান না। ডেমরাসহ দুই সিটি করপোরেশনের নতুন সংযুক্ত ওয়ার্ডগুলোতে মশার অবস্থা আরও ভয়াবহ। অনেক এলাকার বাসিন্দারা দিনের বেলায়ও মশারি বা কয়েল ছাড়া ঘুমাতে পারেন না।' উত্তরা এলাকার বাসিন্দা লুৎফুন্নাহার বলেন, 'ফগার মেশিনে মশার ওষুধ ছিটালে ড্রেনে বা বাইরে থাকা মশাগুলো ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এতে মশাগুলো রাস্তা থেকে তাড়িয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।' পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকার আশরাফ হোসেন বলেন, 'মশা মারার জন্য ধোঁয়া উড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এসব ধোঁয়া উড়িয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না। নগরীর রাস্তাঘাট, ড্রেন, নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করলে এমনিতেই মশা কমে যেত।' খিলক্ষেত এলাকার নাজমুল হাসান জানান, নিকুঞ্জ এলাকায় সন্ধ্যার দিকে প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। সম্প্রতি মশার যন্ত্রণায় এই এলাকার আশপাশেও যাওয়া যায় না। ফুটপাতে হাঁটতে গেলেও নাকে মুখে মশা ঢুকে পড়ার উপক্রম হয়। বনশ্রী এলাকার জসিম উদ্দিন নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, 'মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারলে আমরা ঢাকার দুই মেয়রকে সাধুবাদ জানাব। কিন্তু আমার মনে হয় তারা অন্য কাজ নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। মশার চেয়ে বাস ভাড়া কমানো-বাড়ানো নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন।' জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য বছরের তুলনায় এবার ঢাকায় মশা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় চারগুণ। কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক ডক্টর কবিরুল বাশারের গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও, শনির আখড়া, শাঁখারিবাজার, মোহাম্মদপুর ও পরীবাগে প্রতিটি ডিপ-এ (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) গড়ে ৬০টির বেশি মশা পাওয়া গেছে। যা এ পর্যন্ত সর্বাধিক। বছরের অন্য সময়ে যার সংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০টির মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতি মাসে আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৬টি এলাকায় মশার ঘনত্ব বের করি। মশা নিয়ে গবেষণা চালাই। জানুয়ারির শেষে গবেষণায় দেখা যায়, যেসব মশার কামড়ে নগরবাসী অতিষ্ঠ তার মধ্যে ৯৯% কিউলেক্স মশা। নর্দমা, ড্রেন, ডোবা, বিল-ঝিলের পচা পানিতে এসব কিউলেক্স মশা জন্মায়। এবার তুলনামূলক মশার ঘনত্ব কয়েকগুণ বেশি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, 'গত কয়েক বছর এক ধরনের ওষুধ ছিটিয়ে আসছে সিটি করপোরেশন। এই ওষুধ মশার অনেকটা সহনীয় হয়ে গেছে। ফলে নিয়মিত ওষুধ ছিটালেও তেমন একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন ওষুধের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মশা নিধনে ওষুধের মান বারবার পরীক্ষা করা হচ্ছে।' তিনি বলেন, 'যখনই মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ওষুধের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাই, সঙ্গে সঙ্গে তা পরীক্ষা করানো হয়। আমরা এতবার পরীক্ষা করাই যে, সবাই অতিষ্ঠ হয়ে যায়। ডেঙ্গুর জন্য যে ওষুধ প্রয়োগে সুফল পাওয়া যায়, কিউলেক্স মশার জন্য তা কার্যকর হয় না। সেজন্য আমরা ওষুধ পরিবর্তন করছি। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন ওষুধ চলে আসবে। সেটা আমরা কিউলেক্স মশার জন্য ব্যবহার করব। কিউলেক্স মশার উপদ্রব বাড়ার যে অভিযোগ আসছে, সেটা নিরসন হবে।'