স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ঘোষণার দিন আজ

প্রকাশ | ০৩ মার্চ ২০২১, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
আজ ৩ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল ১৮ ফাল্গুন ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ, বুধবার। আগের দিন অর্থাৎ ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। বাংলাদেশ তখন উত্তপ্ত। এর আগে জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদে পার্লামেন্টারি গ্রম্নপের ১২ জন নেতাকে ১০ মার্চ ঢাকায় বৈঠকের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন। একাত্তরের এই দিনে ঘোষিত হয় স্বাধীনতা-সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এ দিনে। পূর্ব সিদ্ধান্তের আলোকে আজকের দিনে ঘোষণা করা হয়- এ দেশের নাম হবে 'বাংলাদেশ', পতাকা হবে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি 'আমার সোনার বাংলা' হবে জাতীয় সংগীত, বঙ্গবন্ধু হবেন জাতির পিতা আর 'জয় বাংলা' হবে জাতীয় সেস্নাগান। বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করে গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধের সব রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণও হয় ঐতিহাসিক এই দিনে। গুলি করে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা, জেল-জুলুম-অত্যাচার ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবিতে এ দিনও সারাদেশে স্বতঃস্ফূর্ত সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। একাত্তরের ৩ মার্চ ছিল রক্তঝরা দিন। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে শতাধিক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। বিক্ষোভে উত্তাল ৩ মার্চে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগের বিশাল জনসমাবেশ। এই সমাবেশ থেকেই স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও লাগাতার হরতালের ডাক দেন। সামরিক আইন প্রত্যাহার করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি। সব দাবি মেনে নিতে সামরিক জান্তাকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় দিয়ে তিনি ঘোষণা দেন ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালন করা হবে। ওই সমাবেশ থেকেই বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ জনসভার ঘোষণা দেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত পল্টনের বিশাল সমাবেশ থেকে আসা এ ঘোষণার পরপরই '৭১-এর এ দিনে রাজধানী ঢাকা হয়ে ওঠে প্রতিরোধ আর সংগ্রামের নগরী। পল্টন ময়দানের ওই সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা শাজাহান সিরাজ। ইশতেহারে বলা হয়, দেশের প্রতিটি গ্রাম, মহলস্না থানা, মহকুমা শহর ও জেলায় 'স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করতে হবে। গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় গঠন করতে হবে মুক্তিবাহিনী। এই ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার ঘোষণা, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের অনুমোদনসহ স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করে উপস্থিত লাখ লাখ মানুষের অনুমোদন নেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সমাবেশে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ জাতীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন। ৩ মার্চ পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল ঘোষণার প্রতিবাদে এ দিনও সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। এই দিন আন্দোলনরত বাঙালিদের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর গুলিতে চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণ হারান অনেকেই। বর্বর এ ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোর রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার জনতা। পল্টন ময়দানের এ জনসভায় পুনরায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই জনসভা থেকেই মূলত ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে সর্বস্তরের জনতাকে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। জনসভার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ৭ মার্চের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়া হবে। আর সে কারণে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। এ দিন বিক্ষোভে ফেটে পড়া পূর্ব বাংলার জনগণকে দমন করতে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এ বৈঠকের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, এমন কিছু লোকের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাদের জঘন্য ও ঘৃণ্য চক্রান্তের কারণে নিরীহ, নিরস্ত্র চাষি, শ্রমিক ও ছাত্রকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তিনি এ বৈঠককে 'এক নিষ্ঠুর কৌতুক' অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ছাত্রনেতা ফারুক ইকবালের শাহাদতবার্ষিকী। একাত্তরের এই দিনে ছাত্রনেতা ফারুক ইকবাল একটি প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে রামপুরার টিভি স্টেশনে যান। সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ ও পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হন তিনি। অকুতোভয় এ ছাত্রনেতার লাশ বহনকারী একটি বিশাল মিছিল ওই দিন পল্টনে আহূত জনসভায় যোগ দিলে সেখানে উপস্থিত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।