শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আস্থার সংকটে স্বাস্থ্য খাতে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে

দেশে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যকার আস্থার সংকট ব্যাপক। এ সংকট বেশ আগে থেকে চলমান থাকলেও করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। উভয়পক্ষের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৪ মার্চ ২০২১, ০০:০০

গত সোমবার কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এক প্রসূতি মায়ের মৃতু্যর পর ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে শহরের সাজেদা-আলাল নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভাঙচুর করেন রোগীর স্বজনরা। এ সময় তারা উত্তেজিত হয়ে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের খুঁজতে থাকেন। এতে ভয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যান তারা। স্বজনদের অভিযোগ, সিজার করার সময় অ্যানেসথেসিয়া ভুল করার কারণে রাশেদা বেগম মারা যান। তবে চিকিৎসকের দাবি, এ অভিযোগ একেবারেই অবান্তর।

এর আগে গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি আড়াইশ' শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুর মৃতু্যর ঘটনায় জরুরি বিভাগে ভাঙচুর করেন ক্ষুব্ধ স্বজনরা। তারা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সকে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনায় নিহতের তিন স্বজনকে আটক করে পুলিশ।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, 'শিশুটি বিদু্যৎস্পৃষ্ট হয়ে দোতলার ছাদ থেকে নিচে পড়ে যায়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রম্নত ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যেতে বলেন। কিছুক্ষণ পরেই শিশুটি মারা যায়।' তবে স্বজনদের অভিযোগ, 'প্রায় এক ঘণ্টা তাকে চিকিৎসা ছাড়াই ফেলে রাখা হয়। আর এ কারণেই তার মৃতু্য হয়েছে।'

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যকার আস্থার সংকট ব্যাপক। আর এ কারণেই স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলা ও হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এ সংকট বেশ আগে থেকে চলমান থাকলেও করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক সৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি আরও বেগতিক হতে পারে। এতে রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী দু'পক্ষেরই প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

অথচ এ নিয়ে বছর সাতেক আগে 'রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন- ২০১৬' নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি হলেও তা এখনো পাস হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, চিকিৎসকরা আগে নিজেদের সুরক্ষায় আলাদা আইন চাইছে। তারা রোগী বা দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পৃথক আইনের বিপক্ষে। তাই এই আইন বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।

তবে বিএমএর নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, দেশের বিদ্যমান বিভিন্ন আইনেই রোগীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু চিকিৎসকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় কোনো আইন নেই। এছাড়া খসড়া

আইনে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে- বিএমএ যার সংশোধন চেয়েছে।

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা পাঁচ বছর আগে আইনটির খসড়া প্রস্তুত করি। কিন্তু চিকিৎসকদের বাধার মুখে এই আইন আলোর মুখ দেখছে না। প্রস্তাবিত আইনে চিকিৎসক বা রোগীর পক্ষে-বিপক্ষে কিছু নেই। চিকিৎসক নেতারা অনেকে খসড়া না পড়েই বিরোধিতা করছেন। তারা একটি খসড়া দিয়েছেন, যা কোনো আইন হতে পারে না। তবে তাদের প্রস্তাবের কিছু কিছু বিষয় গ্রহণ করা যেতে পারে।'

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনেকে এটিকে চিকিৎসক নেতাদের বাড়াবাড়ি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা মনে করেন, রোগী যখন কোনো বিষয়ে ডাক্তারের সহযোগিতা প্রার্থী হন, ডাক্তার সেটা দেখেন কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থাৎ আমি বললাম, আপনি এটা করুন। আসলে হওয়া উচিত, ডাক্তার তার লব্ধ জ্ঞানকে রোগীর কাছে রোগীর মতো করে উপস্থাপন করবেন। সেটা করতে গেলে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। অথচ বেশিরভাগ চিকিৎসকই তা করেন না। আর এ কারণেই আস্থার সংকট দিনে দিনে ঘনীভূত হচ্ছে- যোগ করেন তারা।

ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, প্রশ্নের জবাব দেন না এবং যথেষ্ট সময় দেন না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরাও তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য পান না। এমনকি রোগী হিসেবে যেসব অধিকার রয়েছে, তার নূ্যনতম প্রাপ্তি থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বেশিরভাগ চিকিৎসক গলাকাটা ফি আদায় করেন। সেবার নামে তারা অনেকে ব্যবসা ফেঁদে বসে আছেন।

রাজধানীর মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা নেছারুল হক জানান, তার বড় ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে তিনি ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। প্রতিদিন সকালে যখন বড় ডাক্তার রাউন্ডে আসতেন তখন রোগীর অ্যাটেন্ডেন্ট সবাইকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়া হতো। তিনি চলে যাবার পর একজন জুনিয়র ফাইলে ওষুধ, টেস্ট ইত্যাদি লিখে দিতেন। পরে সেটি দেখে নার্স রোগীর সঙ্গীয় স্বজনদের ওষুধ আনতে বলতেন। কিন্তু রোগীর উন্নতি কতটা হচ্ছে, কোন ওষুধ কেন দেওয়া হচ্ছে, সেটা কখনোই কাউকে বলা হতো না। জুনিয়রদের কাছে জিজ্ঞেস করলে তারাও বিরক্ত হতেন। কখনো-বা ধমক দিতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরকম অভিজ্ঞতা শুধু নেছারুল হকের একার নয়, অনেকেরই রয়েছে। এছাড়া বড় বড় চিকিৎসকদের কাছ থেকে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া এবং অযথা টেস্ট করানোর পরামর্শ দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে শুধু সরকারি হাসপাতালেই নয়, উন্নত চিকিৎসার জন্য অর্থ খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েও বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে।

বাংলাদেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশে রোগী এবং চিকিৎসক পরস্পরের প্রতি যে দায়বদ্ধতা, ডাক্তার এবং রোগীর সম্পর্ক যে অলিখিত বোঝাপড়ার একটি সম্পর্ক, সেই সম্পর্কে তাদের কারও ধারণা নেই।'

তিনি মনে করেন, 'চিকিৎসক এবং রোগীর এই যোগাযোগের জায়গাটায় বড় একটি ঘাটতি রয়েছে। আর এ কারণেই তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটে। তখন একে অপরের প্রতি দোষারোপ করেন।' দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিয়ে অনেক অপ্রতুলতা রয়েছে বলে অভিমত দেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে রোগীরাও সচেতন নন বা জানেন না। ফলে তারা তাদের অধিকার দাবি করতে পারেন না বা আদায় করে নিতে পারছেন না। তাদের জানতে চাইতে হবে। সেই ব্যাপারে তাদেরও সচেতন হওয়া দরকার। আর এটি হলে চিকিৎসকদের ভেতর ট্রেন্ডটা চালু হবে।

চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে রোগীর কী কী অধিকার রয়েছে- সে সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের সব দেশেই রোগীদের প্রধান অধিকার হচ্ছে চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তির অধিকার।

অর্থাৎ তাকে কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, কার কাছ থেকে নিচ্ছেন, সেটার জন্য কেমন খরচ হবে, কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে বা হবে, কোনটা করলে ভালো হবে, না করলে কী কী সমস্যা হতে পারে, শারীরিক কোনো অসুবিধা হতে পারে কি না, এমনকি মানসিক কোনো সমস্যা হতে পারে কি না- প্রতিটি তথ্য রোগী বা তাদের স্বজনদের জানার অধিকার রয়েছে। সেবা পাওয়ার সময় তার যদি কোনোরকম ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে, সেটাও তাকে আগে থেকে অবহিত করতে হবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে চিকিৎসক, নার্স- যেই হোক, রোগী বা তার অ্যাটেন্ডডেন্টের যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, সেটার উত্তর তাকে দিতে হবে। কিন্তু এসব অধিকার রক্ষায় দেশে অনেক ঘাটতি রয়েছে। আর এ কারণেই আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে