বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ

ফয়সাল খান
  ০৭ মার্চ ২০২১, ০০:০০
১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -ফাইল ছবি

'রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআলস্নাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ১৯৭১ সালের এই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে এ ঘোষণা করেন। ডাক দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের। ঐতিহাসিক সেই ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন।

সুদীর্ঘকালের আপসহীন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালির। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু স্স্নোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালি রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণই বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল।

এদিকে, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ জাতীয় দিবসে সারাদেশে নির্দিষ্ট সময়ে একযোগে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হবে। শনিবার সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, '৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে সময়টিতে ভাষণ দিয়েছেন ঠিক সে সময় সারাদেশে সব মাধ্যমে ভাষণটি প্রচার করা হবে, ৩টা ১৮ বা ২০ মিনিটে। আমরা কাছাকাছি সময়ে থাকার চেষ্টা করব।' তিনি দুপুরে শিল্পকলা একাডেমির সেমিনারকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।

সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'ভাষণটি বিটিভিসহ সব টিভি চ্যানেল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একযোগে প্রচার হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যখন ভাষণটি প্রচার হবে, তখন শুধু ভাষণই প্রচার করা হবে।'

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে সচিব মো. বদরুল আরেফিন বলেন, বাংলাদেশে তখন আর কোনো অনুষ্ঠান হবে না। সে সময় শুধু ভাষণটি প্রচার হবে। ৫০ বছর আগে যে সময়ে বক্তব্যটি প্রচার হয়েছিল সে সময়ই আমরা প্রচার করব বলে সব মহল থেকে সুপারিশ হয়েছে। যে ভাষণটি সরকারিভাবে পিআইডির কাছে আছে, সেটি বিটিভি থেকে সব মাধ্যমে সম্প্রচার হবে। আমরা ৫০ বছর আগের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছি।'

অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ফ্রান্সে বাংলাদেশ দূতাবাস ও ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন যে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে, জাতিসংঘের ছয়টি

দাপ্তরিক ভাষায় তার মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে শুক্রবার এই অনুষ্ঠান হয় বলে বাংলাদেশ মিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

একাত্তরের এই দিনে ঢাকা ছিল লাখো মানুষের শহর। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ৬

ছুটে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো' স্স্নোগানে ঢাকা-শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কখন ঘটবে বিস্ফোরণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে সারাশহরে। শেখ মুজিব নিজ মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ দেননি হানাদারদের। টান টান উত্তেজনার মধ্যে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় এই সমাবেশ।

বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। আর বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে এ নির্দেশ পেয়েই নিরস্ত্র বাঙালি জাতি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে। বাঙালির দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় পরাস্ত করে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে।

একাত্তরের এই দিনটিতে পাকিস্তানি শাসকদের ২৩ বছরের শোষণের বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো জেগে ওঠা পুরো বাংলাকে এক সুতোয় বাঁধেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনৈতিক কবি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র ১৯ মিনিট ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। তার অলিখিত ওই ভাষণ বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসের এক মহামূল্যবান দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষণটিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের বর্ণনা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের অপচিত্র, সময়ভেদে বাঙালি জাতির করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কোমলে-কঠোরে উচ্চারিত এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা। তার এ ভাষণই সেদিন সংশয়ে থাকা বাঙালির হৃদয়ে জাগিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। এই ভাষণের পরপরই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। মূলত এই ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা। তিনি বললেন, 'ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।'

৭ মার্চের উত্তাল দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকার এ পথ সে পথ ঘোরে; এ গলি সে গলি সব জায়গায় থেকে আসা সব মিছিলই এসে মিশে রেসকোর্স ময়দানের লাখো জনতার মোহনায়। বিকাল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, দুপুরের অনেক আগেই ময়দানটি রূপ নেয় জনসমুদ্রে। ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ আসে প্রাণের নেতার নির্দেশনার প্রত্যাশায়। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখো লাখো মানুষ তখন নির্দেশের অপেক্ষায়, নেতার ঘোষণার আশায়। ঐতিহাসিক এই ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, ইতোপূর্বে বিভিন্ন আন্দোলনে শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সংবলিত চার দফা দাবি উত্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। এই জনসভায় মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শেষে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে দেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং গোটা জাতির বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের বুকে নতুন করে লেখা হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাম।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। সকালে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন। এরপর রাষ্ট্রীয় ও দলীয়ভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে