ভয়াল করোনা মহামারির বছর পূর্ণ হলো আজ

আক্রান্ত ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০, মৃতু্য ৮ হাজার ৪৬২

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২১, ০০:০০

জাহিদ হাসান
দেশে মহামারি করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ৮ মার্চ সোমবার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ করোনা বিষয়ক বুলেটিন অনুযায়ী রোববার পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। মৃতু্য হয়েছে ৮ হাজার ৪৬২ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৩ জন। গত বছরের এইদিন (৮ মার্চ) সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর খবর। তখন তিনজন রোগী শনাক্তের কথা বলা হয়েছিল। তখনই মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল ভয়, আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি। ওই সময়ে পুরোবিশ্বই করোনা মোকাবিলায় গলদঘর্ম, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আক্রান্তদের সেবা দিতে শুরু করেন চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থেকে তারা দিন-রাত করোনার রোগীদের সেবা দিতে শুরু করেন। সম্মুখ সারির যোদ্ধা হিসেবে সেবা দিতে গিয়ে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, মারাও গেছেন। তবে করোনা টেস্ট ও সেবার নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের দুর্নীতি ছাড়াও সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে খোদ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার নাম শীর্ষে ওঠে এসেছে। ফলে মহামারি রুখতে এই দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের বদলিসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ভূমিকাও দেখা গেছে। সবমিলে প্রায় এক বছর পরে সংক্রমণ কমানো ও টিকা প্রয়োগ শুরুর মাধ্যমে সরকার করোনা প্রতিরোধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। দেশে গত এক বছরে করোনা সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৬ মার্চ যখন লকডাউন শুরু হয়, তখন মাত্র ৩৯ জনের রোগ শনাক্ত হয়। ওই সময় পর্যন্ত মারা যান মাত্র পাঁচজন। পরবর্তীতে করোনার সংক্রমণ রোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। বেশি সংক্রমিত এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সব ধরনের পরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন করণীয় বিষয় নিয়ে ঘোষণা আসতে থাকে। বছরের মাঝামাঝি সময় করোনার সংক্রমণ কমলেও তা আবারও বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ রোধে সবাইকে বারবার হাত ধোঁয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ মুখে মাস্ক পরতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। করোনায় এক বছরে আক্রান্ত ও মৃতু্যর চিত্র : ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল ৫১ জন। এভাবে এপ্রিলে ৭ হাজার ৬১৬ জন, মে'তে ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন, জুনে ৯৮ হাজার ৩৩০ জন, জুলাইয়ে ৯২ হাজার ১৭৮ জন, আগস্টে ৭৫ হাজার ৩৩৫ জন, সেপ্টেম্বরে ৫০ হাজার ৪৮৩ জন, অক্টোবরে ৪৪ হাজার ২০৫ জন, নভেম্বরে ৫৭ হাজার ২৪৮ জন, ডিসেম্বরে ৪৮ হাজার ৫৭৮ জন। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২১ হাজার ৬৩০ জন আক্রান্ত হন। তবে ফেব্রম্নয়ারিতে সংক্রমণ কমে ১১ হাজার ৭৭ জনে দাঁড়ায়। অন্যদিকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের মার্চে ৫ জন, এপ্রিলে ১৬৩ জন, মে'তে ৪৮২ জন, জুনে ১ হাজার ১৯৭ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ২৬৪ জন, আগস্টে ১ হাজার ১৭০ জন, সেপ্টেম্বরে ৯৭০ জন, অক্টোবরে ৬৭২ জন, নভেম্বরে ৭২১ জন, ডিসেম্বরে ৯১৫ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৬৮ জনের মৃতু্য হয়েছে। করোনায় জনজীবনে প্রভাব :দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ই মার্চ। সেদিন আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্তের তথ্য জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ। যাদের দুইজন ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এই ঘোষণা আসার পর বাজারে মাস্ক, স্যানিটাইজারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। অতিরিক্ত দাম রাখার কারণে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি সিলগালা করে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ১১ মার্চ আইইডিসিআর জানায়, করোনাভাইরাসকে মহামারি বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১৩ মার্চ জানায়, করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি হটলাইন নম্বর চালু করে আইইডিসিআর। তবে অনেকেই অভিযোগ করেন, বারবার চেষ্টা করেও তারা এসব হটলাইনে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল :মার্চেই সরকারের ঘোষিত মুজিববর্ষ বিপুল আয়োজনে শুরু হওয়ার কথা ছিল। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করে সরকার। দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আয়োজনের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু প্রথম রোগী শনাক্তের পর ৮ই মার্চ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সীমিতভাবে উদযাপিত হবে। সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা :১৯ মার্চ সংক্রমণ রোধে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয়। শিবচরে ওষুধের দোকান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ৭ এপ্রিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর নারায়ণগঞ্জকে লকডাউন ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এছাড়া ২৬ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে ছুটি বাড়িয়ে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে সব ধরনের আয়োজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সাধারণ ছুটির মধ্যে ওষুধ, কাঁচাবাজার ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসব দোকান বন্ধ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বাতিল করা হয় ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা। এ সময় সব ধরনের যানবাহন, রেল, নৌ ও বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। জনসাধারণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে দেশজুড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করার আগেই বিপুল মানুষের ঢল নামে, যারা কোনোরকম সামাজিক দূরত্বের পরোয়া না করে বাড়ির পথে রওনা হন। এভাবে টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহণ চলাচালের অনুমতি দেয় সরকার। মুসলিস্নদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ : ধর্ম মন্ত্রণালয় এক ঘোষণায় মুসলিস্নদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেয়। সেখানে বলা হয়, শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম মসজিদে নামাজ আদায় করবেন। বাইরের মুসলিস্নরা কেউ মসজিদে জামাতে অংশ নিতে পারবেন না। কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে মসজিদে ভিড় করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে। অন্য সবাইকে বাসায় নামাজ পড়তে বলা হয়। দ্রম্নত বাড়তে থাকে শনাক্ত ও মৃতু্য:এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে রোগীর সংখ্যা দ্রম্নত বাড়তে থাকে। ৩০ জুন একদিনেই ৬৪ জনের মৃতু্যর খবর জানানো হয়। যা করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে একদিনের সর্বোচ্চ মৃতু্য। আর ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, যা একদিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। লকডাউনের মধ্যে কষ্টে পড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যও স্থবির হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কল কারখানা বন্ধ থাকায় এবং অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়ায় বড় ধরনের অর্থনৈতিক জটিলতার দিকে যেতে থাকে পরিস্থিতি। করোনা মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ :করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবিলায় সক্ষমতাসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে 'করোনা সহনশীল' দেশের আন্তর্জাতিকর্ যাঙ্কিং প্রকাশ করছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম বস্নুমবার্গ। ডিসেম্বরে বস্নুমবার্গ প্রকাশিত এইর্ যাংকিংয়ে ২০ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বস্নুমবার্গেও 'কোভিড রেজিলিয়েন্সর্ যাংকিং'- এ দেখা গেছে যে,র্ যাংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোর চেয়েও এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই। এই তালিকার ভারত-পাকিস্তানের ঠাঁই হয়েছে তালিকার নিচের দিকে। বস্নুমবার্গেরর্ যাংকিং অনুসারে গত নভেম্বরে ২৪ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দক্ষতা দেখিয়ে একমাসের ব্যবধানে চারধাপ ওপরে উঠে এসেছে। বস্নুমবার্গের হিসাবে, জীবনযাত্রার মান নির্ণায়ক সূচকগুলোর মধ্যে জিডিপি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার গতির দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ এখনো জনজীবনে লকডাউনের প্রভাব আর স্বাস্থ্যসেবার মানের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। কমছে করোনা সংক্রমণ :দেশে শীতের মৌসুমে করোনার সংক্রমণ বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। সে আশঙ্কা দূর করে চলতি বছরের প্রথম মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে সংক্রমণের হার। সংক্রমণের দশ মাসে অর্থাৎ এই বছরের ৯ জানুয়ারি দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের হার ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসে। সেদিন পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গত এক মাস ধরেই এই হার কমছিল। তবে দেশে ব্যাপক হারে পরীক্ষা শুরুর পর গতকালই প্রথম শনাক্তের হার ৬-এর নিচে নামল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের ৩ ও ৪ এপ্রিল শনাক্তের হার ২ শতাংশের ঘরে ছিল। তবে তখনো রোগটি সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি এবং পরীক্ষার সংখ্যাও ছিল সীমিত, অর্থাৎ পাঁচশ'র কম। এর আগে গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর প্রথম এক মাস সংক্রমণের মাত্রা ছিল খুবই কম। তখন পরীক্ষা কম হওয়ার পাশাপাশি শনাক্তও কম ছিল। দেশজুড়ে টিকাদান শুরু :গত ৭ ফেব্রম্নয়ারি থেকে সারাদেশের সরকারি বেসরকারি ১ হাজার ৫টি হাসপাতালে করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেদিন থেকে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ টিকাদান কর্মসূচি চলছে। সর্বশেষ রোববার পর্যন্ত টিকা নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫২ জন। তার মধ্যে পুরুষ ২৪ লাখ ২০ হাজার ৮৫৩ জন, নারী ১৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৯৯ জন। টিকা গ্রহীতাদের মধ্যে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে ৮৪৮ জনের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ৭ হাজার ২০০ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬৫ হাজার ৪৩০ জন, নারী ৪১ হাজার ৭৭০ জন।