বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
আজ বিশ্ব নারী দিবস

বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী

'করোনাকালে নারী নেতৃত্ব গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব'
আহমেদ তোফায়েল
  ০৮ মার্চ ২০২১, ০০:০০

'বাজার থেকে ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কী আনা হবে, কী রান্না হবে, টাকা কোথায় খরচ হবে, ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার কি না, সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া'- পরিবারে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একসময় পুরুষরা যেখানে ছড়ি ঘোরাতেন, সেখানে এখন বড় পরিবর্তন এনেছেন নারীরা। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সংসার পরিচালনায় এখন নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। ১০ বছর আগে শ্রমশক্তিতে পুরুষের তুলনায় নারীরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও এখন পালস্না দিয়ে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা একসময় খুব কম হলেও এখন তা অনেক বেড়েছে। বেশি দিন বাঁচার ক্ষেত্রে পুরুষকে পেছনে ফেলেছেন নারী।

শপিং মল, করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক পদে নারী দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষতার সঙ্গে। বিক্রয়কর্মী ও হস্তশিল্পে পুরুষের সঙ্গে ভাগ বসাচ্ছেন নারী। কৃষিতে যে বিপস্নব চলছে সেখানে নারীর অংশগ্রহণ দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশই পোশাক খাত হওয়ার পেছনের কারিগর কিন্তু নারীরাই।

নারীদের এমন এগিয়ে চলার পরিস্থিতিতে আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিনটি উদ্‌যাপিত হয়। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য 'করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব'

জানতে চাইলে বার্জার পেইন্টসের ব্যবস্থাপনা

\হপরিচালক রূপালী চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, নারীদের আস্থা ও সাহসের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতা দরকার। নারীদের ঘর সংসার সামলাতে হয়। সন্তান পালনেও তার ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। এত কিছুর পরও অফিসে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হয় তাদের। প্রত্যেক অফিসে মানসম্পন্ন শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকতে হবে। আবার একটু বড় হলে স্কুলের ব্যবস্থাও এমন থাকতে হবে যেন অফিস, পড়াশোনা ও ঘর সংসারের মধ্যে সব কাজ সহজে সমন্বয় করা যায়। সে ক্ষেত্রে স্বামী চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী হলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্যোগ স্বামীর দিক থেকেও আসতে হবে। উন্নয়নশীল অনেক দেশেই আজকাল এসব ব্যবস্থা রয়েছে।

তিনি বলেন, এখন তো অনেক পরিবারে শিশুর মা সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যান, পড়াশোনা করতে সহায়তা করেন। এ শিশুরা মায়ের সান্নিধ্য বেশি পায়। ফলে ব্যবসা বা চাকরিতে উঁচু পদে উঠতে হলে সংসার ও কর্মক্ষেত্রের দায়-দায়িত্ব ও কাজ এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে যেন তাদের শিশু মা-বাবার সান্নিধ্য লাভে ঘাটতি অনুভব না করে। এই অর্থে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজের সদস্যদের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যানধারণা, নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ সব কিছুতে পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই নারীর উচ্চতর পদে ভূমিকা রাখা সহজ হবে।

এদিকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের উচ্চতর স্তরে বাংলাদেশের উত্তরণের পেছনে বড় উপাদান হসেবে ভূমিকা পালন করেছেন নারাীরা। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী উন্নয়নের ধারা অনুসরণ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনামের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেই এগিয়ে চলেছে। গত এক দশকে দেশের রপ্তানি আয় মার্কিন ডলারের হিসাবে ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক খাত। অর্থাৎ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার কথাটা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোসহ (বিবিএস) বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নারীর ক্ষমতায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ডিজিটাল আর্থিক সেবা বা (ডিএফএস)। গৃহস্থালির কাজ সামলানো, কর্মক্ষেত্রের ঝামেলাসহ ঘরে-বাইরে চলার পথে প্রতিদিন হাজারো সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার পরও দেশের ৮৫ শতাংশ নারী বলছে, জীবন নিয়ে তারা সুখী। বাকি মাত্র ১৫ শতাংশ বলেছে, তারা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। গ্রামের চেয়ে শহরের নারীরা সুখী বেশি। সবচেয়ে বেশি সুখী বরিশাল বিভাগের নারীরা। আর নিজের জীবন নিয়ে সবচেয়ে কম সুখী রংপুর বিভাগের নারীরা। বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলার স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ বৈশ্বিক নানা সংস্থার প্রতিবেদনেও।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মতো একজন নারীকে স্পিকার হিসেবে দেখেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা রাষ্ট্রদূত হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রী, সচিবসহ জেলা প্রশাসক বা ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধি বাড়ছে তরতর করে। রাজনৈতিক দলগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ ও তাদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদান দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীর অগ্রগতি অব্যাহত।

বিবিএসের জেন্ডার বা লিঙ্গ পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে ২০১২ সালে দেশে নারীদের সাক্ষরতার হার ছিল ৮২ শতাংশ, সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯ শতাংশ। নারীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের চিত্রও চমৎকার। বিনা মূল্যে বই বিতরণের পাশাপাশি উপবৃত্তির ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবস্থান এখন বেশি। উচ্চশিক্ষায়ও ছেলেদের কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছেন মেয়েরা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন মজবুত হচ্ছে। ব্যবসা ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন যায়যায়দিনকে বলেন, দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করতে নারীদের মধ্যেও ব্যাপক সম্ভাবনা আছে, যা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে নারী কী করতে পারে সেটাও দেখা গেছে। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে বের হয়েই নতুন নতুন কাজে যোগদান করছেন। নারীদের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও পদে পদে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে দেশের উন্নয়নে নারীদের আরও বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। যদি নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে তাদের শিশুদের 'ডে কেয়ার' নিশ্চিত করা সম্ভব হয় তাহলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, বছরের পর বছর গৃহস্থালির কাজ শুধু নারীরাই করে যাচ্ছেন। এ সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। মেয়েদের যাতায়াত বড় একটি বাধা। নারীদের যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে।

একজন নারী কতটা সুখী বা তার নিজ জীবন নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট তা নিয়ে গত বছর একটি জরিপ পরিচালনা করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো। সারাদেশে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ৬৪ হাজার ৩৭৮ নারীকে জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ বলেছে, তারা নিজ জীবন নিয়ে সুখী। যদিও ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারীদের সুখী থাকার হার আরও বেশি (৯০ শতাংশ)। বিবিএস বলছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারীদের যেহেতু সংসারের চাপ থাকে না, সে জন্য তাদের মধ্যে জীবন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করার হারও বেশি। এই শ্রেণির প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন নারীই সুখী অথবা মোটামুটি সুখী। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দুটি দেশের তুলনা করলে দেখা যায়, নেপালে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। অন্যদিকে পাকিস্তানে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে সুখীর হার ৮১.৫ শতাংশ, যা বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ কম।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা গ্রামাঞ্চলে নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখন গ্রামের মায়েরা তাদের মেয়েদের নিয়ে চিন্তিত নন। মেয়েদের কাছে টাকা না থাকলে সহজে মোবাইল ফোনে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পড়াশোনা করতে গিয়ে মেয়েরা এখন অনেকটা নিরাপদ। টাকা সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হয় না। এই বিপস্নব পোশাকশিল্পেও ঘটেছে। স্মার্ট ফোনের ব্যবহার বাড়লে নারীদের মধ্যে আয়বর্ধক কাজ আরও বাড়বে বলে জানান নাজনীন আহমেদ।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস : নারীদের এমন এগিয়ে চলার পরিস্থিতিতে আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- 'করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব।'

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। তাদের ওপরে দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ। নানা ঘটনার পর ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন করছে। তখন থেকেই বিভিন্ন দেশে নারীর সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে দিবসটি পালন শুরু হয়।

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতীয় পর্যায়ে ৫ জনকে 'শ্রেষ্ঠ জয়িতার' সম্মাননা দিচ্ছে সরকার। তারা হলেন- বরিশালের হাছিনা বেগম নীলা, বগুড়ার মিফতাহুল জান্নাত, পটুয়াখালীর মোসাম্মৎ হেলেন্নছা বেগম, টাঙ্গাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিজান এবং নড়াইলের অঞ্জনা বালা বিশ্বাস। আজ নারী দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ এই পাঁচ জয়িতাকে সম্মাননা দেওয়া হবে। নারী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীসহ বিশেষ ক্রোড়পত্র ও স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে সংবাদপত্রে। টেলিভিশন ও বেতারে নারীর অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ আলোচনা এবং প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের মতো আয়োজন থাকছে।

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং এ বিষয়ে প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টিতে শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে