শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট নিয়ে বিপাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

দেশে আমদানিকৃত লাখ লাখ পিসর্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের কী গতি হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এখন উদ্বিগ্ন কেননা, এসব টেস্ট কিটের নির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার পর তা ব্যবহার করা যাবে না অর্থাৎ পুরোপুরি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়বে
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০

করোনা সংক্রমণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরার্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরুর তাগিদ দিলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় সে সময় তা চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে সংক্রমণের মাত্রা ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসার পর গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশের ১০ জেলায় এ টেস্ট চালু করা হয়। যদিও পরের মাস থেকে সংক্রমণের হার ধাপে ধাপে কমে ফেব্রম্নয়ারি মাসে এসে তা ৩ শতাংশে ঠেকে। এ অবস্থায় অতিসম্প্রতি অ্যান্টিজেন টেস্টের পরিধি আরও বেশখানিকটা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। অথচ এ পর্যায়ে দেশে আরটিপিসিআর মেশিনে টেস্ট করানোর মতো পর্যাপ্ত রোগীই নেই। ফলে করোনার উপসর্গ নিয়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট করানোর মতো মানুষের দেখা মেলাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ অবস্থায় দেশে আমদানিকৃত লাখ লাখ পিসর্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের কী গতি হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এখন উদ্বিগ্ন। কেননা, এসব টেস্ট কিটের নির্ধারিত মেয়াদ পার হওয়ার পর তা ব্যবহার করা যাবে না, অর্থাৎ পুরোপুরি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়বে। যা অ্যান্টিজেন টেস্টের কিটের প্যাকেটের গায়েই স্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে। এছাড়া দেশে করোনার টিকাদান কর্মসূচি যেভাবে এগিয়ে চলছে, তাতে সহসাই এ মহামারিতে আক্রান্ত রোগী আরও দ্রম্নত কমে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের চাহিদা অনেকাংশেই কমে আসবে। এ পরিস্থিতিতে দেশে মজুতকৃত কিটের একটি বড় অংশের মেয়াদ পার হয়ে যাবে-এমন আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, এ নিয়ে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ডিসেম্বরে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরুর আগে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেছিলেন, 'বর্তমানে আরটিপিসিআর ১১০টি ল্যাব রয়েছে। যেখানে ২৫ হাজার পরীক্ষা হতে পারে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ হাজারের বেশি টেস্ট হচ্ছে না। কাজেই অ্যান্টিজেন হলে লাভ কী, ওটা তো পড়েই থাকবে। বর্তমানে থাকা ল্যাবই তো ইউটিলাইজ হচ্ছে না, সেখানে অ্যান্টিজেন এনে তো লাভ নেই। সেটা পড়েই থাকবে, কেউ তো আসবে না টেস্ট করার জন্য।'

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উভয় সংকট পরিস্থিতিতে দেশে ৬

আমদানিকৃত অ্যান্টিজেন কিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা কীভাবে পুরোপুরি ব্যবহার করা যায় এ জন্য নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর সমাগম অনুযায়ীর্ যাপিড অ্যান্টিজেন কিট দেওয়া হচ্ছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগীকে অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে। এতে মজুতকৃত কিট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যবহার করা যাবে।

তবে হাসপাতালে আসা সব রোগীর অ্যান্টিজেন টেস্ট করা নিয়েও নতুন সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। রাজধানীর একটি হাসপাতালের একজন নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, তাদের দৈনিক টেস্ট করার জন্য যে সংখ্যক অ্যান্টিজেন কিট নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ব্যবহার করতে হলে এ কাজে টেকনোলজিস্টসহ কমপক্ষে ১০ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে ব্যস্ত থাকতে হবে। অথচ এ বাড়তি কাজ করার মতো ম্যানপাওয়ার তাদের নেই। এ অবস্থায় তারা যেসব রোগী শুধু হাসপাতালে ভর্তি হবেন, শুধু তাদের টেস্ট করার কথা ভাবছেন।

নতুন করে অ্যান্টিজেন টেস্টের দায়িত্ব পাওয়া আরও কয়েকটি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদেরও একই মনোভাব পাওয়া গেছে। প্রয়োজনের সময় এ টেস্ট শুরু না করে করোনা মহামারি সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে তা চালু করার উদ্যোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের 'অদূরদর্শিতা' প্রমাণ বলে অনেকেই মন্তব্য করেন।

এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও কেউ কেউ এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলেও অনেকেই এর সমর্থন করেছেন। অসময়ে অ্যান্টিজেন টেস্ট চালু করা হলেও এ উদ্যোগ করোনা মোকাবিলায় কিছুটা হলেও কাজে লাগবে বলে মনে করেন তারা। তাই তারা এ পরিকল্পনাকে 'মন্দের ভালো' বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোস্তাক হোসেন বলেন, অ্যান্টিজেন টেস্টে বিশেষায়িত কোনো পরীক্ষাগার বা অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হয় না। আবার অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফল দ্রম্নত মেলায় যদি দেশব্যাপী টেস্ট করা হয় তাহলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মূল চিত্র নিরূপণ করে সরকারের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পথ তৈরি হবে। তবে অ্যান্টিজেনের পাশাপাশি অ্যান্টিবডি টেস্টও জোরেশোরে শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, গত ৪ ডিসেম্বর প্রাথমিকভাবে ১০টি জেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করা হয়। মূলত বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে যেসব জেলায় আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সুবিধা নেই অথচ সংক্রমণের হার বেশি, এমন ১০টি জেলাকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়।

এসব জেলায় শুধু যাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ রয়েছে তাদেরই অ্যান্টিজেন পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। এর মধ্যে যাদের ফল পজিটিভ আসছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যদিকে উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও কারও টেস্টের ফল নেগেটিভ আসছে, তাকে পুনরায় আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা করানো হচ্ছে। কারণ অ্যান্টিজেন টেস্টে দ্রম্নত ফল এলেও এতে ফলস নেগেটিভ অর্থাৎ ভুল ফল আসার আশঙ্কাও বেশি থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা বা সিডিসি-এর তথ্য মতে, অ্যান্টিজেন টেস্ট মূলত শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাস শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয়।

এই টেস্টের মাধ্যমে বিশেষ ভাইরাল অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়, যা আসলে ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে মূলত শনাক্ত হয় একটি ভাইরাসের প্রোটিন অংশ। পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে যেমন ভাইরাসের নিউক্লিয়িক অংশ শনাক্ত করা হয়, ঠিক তেমন অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে ভাইরাসের প্রোটিন অংশ শনাক্ত করা হয়।

তবে পিসিআর পদ্ধতিতে খুব অল্প পরিমাণ ভাইরাসও শনাক্ত করা সম্ভব। কারণ এটি ভাইরাসকে বৃদ্ধি করে বা অ্যাম্পলিফাই করে তাকে শনাক্ত করে। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে ভাইরাসের ছোট একটা অংশ বা নিউক্লিয়িক এসিড থাকলেও সেটি শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি সম্ভব নয়। কারণ এটি ভাইরাসকে অ্যাম্পলিফাই করে না। এই টেস্টের মাধ্যমে শুধু ভাইরাসের উপস্থিতি জানা যায়।

অনেক সময় কোনো রোগীর দেহে ভাইরাসের পরিমাণ কম থাকলে সেক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে তার করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ার বিষয়টি নাও জানা যেতে পারে বলে জানান অভিজ্ঞ ভাইরোলজিস্টরা।

বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, অ্যান্টিজেন্ট টেস্টের ফলাফল কতটা নির্ভুল হবে, তা নির্ভর করে কিটের মান, নমুনার মান এবং সংক্রমণের কোন পর্যায়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে-এই তিনটি বিষয়ের ওপর। এ কারণে করোনার লক্ষণ দেখা দিলে কিংবা সংক্রমিত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে এলে তার ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এছাড়া মানহীন কিট হলে বা নমুনার মান খারাপ হলে অ্যান্টিজেন টেস্টের ফলাফল 'ফলস নেগেটিভ' হতে পারে। তবে এই টেস্টে 'ফলস পজিটিভ' আসার আশঙ্কা কম। যদিও অ্যান্টিজেন টেস্টে কারো ফল পজিটিভ আসলে বুঝে নিতে হবে যে তার ওই নমুনা সংক্রমিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে