মিয়ানমারে নিহত আরও ২

শক্তি প্রয়োগেও টলছে না জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ

এবার দেশজুড়ে ধর্মঘট পালন ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ষ সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন অস্ট্রেলিয়ার ষ সংকট সমাধানে সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ চীনের

প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০২১, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
গুলি, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, ধরপাকড় তথা নিরাপত্তা বাহিনীর সব ধরনের শক্তি প্রয়োগ সত্ত্বেও জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ কমার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না মিয়ানমারে। বরং দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে। এদিকে, সোমবার পুলিশের গুলিতে আরও দুইজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই দুই বিক্ষোভকারীর মাথায় গুলি লেগেছিল। অন্যদিকে, সেনাশাসকদের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে সোমবার ধর্মঘট পালন করেছে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ট্রেড ইউনিয়নগুলো। ধর্মঘটের ফলে বন্ধ ছিল দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের দোকানপাট, কলকারখানা। সংবাদসূত্র : রয়টার্স, আল-জাজিরা, এএফপি সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত বেশ কিছু ছবিতে দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলীয় মিতকিনা শহরে দুইজনের মরদেহ রাস্তায় পড়ে আছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহত ব্যক্তিরা বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। তারা বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সময় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে স্টান গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। ওই সময় পাশের ভবনগুলো থেকে গুলি ছোড়া হলে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, তিনি এবং আরও বেশ কয়েকজন রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারীদের মরদেহ সরিয়েছেন। ২০ বছর বয়সি ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'বেসামরিক লোকজনকে গুলি করে হত্যা করাটা কতটা অমানবিক! শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করার অধিকার আমাদের আছে।' এখন পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে দেশটিতে অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। আর রোববার পর্যন্ত আটক হয়েছেন প্রায় ১৮০০ ব্যক্তি। সোমবার এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা আগের দিন ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দেশব্যাপী ধর্মঘটে ট্রেড ইউনিয়ন এদিকে, জেনারেলদের ক্ষমতা থেকে হঠাতে মিয়ানমারের প্রধান ট্রেড ইউনিয়নগুলো সোমবার থেকে ধর্মঘট পালন করেছে। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সংকুচিত করতে এবং ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারকে আরও চাপের মধ্যে ফেলতে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নির্মাণ, কৃষি, পণ্য উৎপাদনসহ অন্তত ৯টি খাতের ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে যোগ দেয়। সেনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে 'মিয়ানমারের সব জনগণকে' কাজে ইস্তফা দেওয়ার ডাকও দেন তারা। ইয়াঙ্গুনের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, শহরের সামান্য কিছু চায়ের দোকান খোলা আছে। বড় বড় শপিং সেন্টারগুলো বন্ধ রাখা হয় এবং বিভিন্ন কারখানায় কোনো কাজ হচ্ছে না। ধর্মঘটের জন্য দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ব্যবসা ও অর্থনীতি সচল রাখলে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা হবে, কারণ তারা জনগণের শক্তি দমন করছে। এতে আরও বলা হয়, 'আমাদের গণতন্ত্রের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনই।' গত ১ ফেব্রম্নয়ারি সামরিক অভু্যত্থানের পরপরই মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, শ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের পেশাজীবীরা কাজে ইস্তফা দিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ শুরু করেন। সোমবার থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এই ধর্মঘটের ফলে বিক্ষোভে নতুন মাত্রা যোগ হলো। সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন অস্ট্রেলিয়ার এদিকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অস্ট্রেলিয়া। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং বিক্ষোভকারীদের মৃতু্যর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ক্যানবেরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যারিস পেন। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'সহনশীলতা প্রদর্শন করতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আমরা জোরালোভাবে অনুরোধ করছি। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো থেকে বিরত থাকতেও দেশটির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।' তিনি বলেন, 'আমরা উন্নয়ন প্রকল্প ও উন্নয়ন সহযোগিতার দিকেও নজর দিচ্ছি, যেটা আমরা প্রদান করছি এবং আসিয়ানের অন্যতম দরিদ্র দেশ মিয়ানমারের সবচেয়ে দুর্বল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য দেওয়ার বিষয়টিতে পুরোপুরি জোর দিচ্ছি।' ক্যানবেরা জানায়, তারা অং সান সু চির উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ শন টার্নেলের মুক্তির দাবি অব্যাহত রাখবে। অভু্যত্থানের পর থেকে শন টার্নেল মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে আটক রয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক মূলত এতদিন অসামরিক পর্যায়েই আটকে ছিল। ২০১৭ সালে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অস্ট্রেলিয়া শুধু ইংরেজি ভাষা শিখতে প্রশিক্ষণ দিত। লন্ডনভিত্তিক সংগঠন 'বার্মা ক্যাম্পেইন'র নির্বাহি পরিচালক অ্যানা রবার্টস বলেন, 'অস্ট্রেলিয়া অবশেষে চূড়ান্তভাবে (মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে) প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা শুরু করাই উচিত হয়নি।' এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'আরও ১২টি দেশ বার্মিজ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। বার্মিজ সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া দেশগুলো জান্তা সরকারের পক্ষ নিয়েছে। তারা প্রকারান্তরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করা বিক্ষোভকারীদের বুকেই গুলি চালাচ্ছে।' বার্মা ক্যাম্পেইনের তথ্যমতে, যেসব দেশ মিয়ানমারকে এখনো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইউক্রেন। সংকট সমাধানে সাহায্য করতে আগ্রহী চীন মিয়নমারে বিক্ষোভ দমনে নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেওয়ায় আন্তর্জাতিক চাপ যখন বাড়ছে, তখন কোনো পক্ষে না গিয়ে বরং 'সব পক্ষের' সঙ্গে আলোচনার ?মাধ্যমে চলমান সংকট সমাধানের পথ সহজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। চীন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা স্টেট কাউন্সেলর ওয়াং ই রোববার বেইজিংয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। চীনের পার্লামেন্টের বার্ষিক সমাবেশ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ওই সংবাদ সম্মেলনে ওয়াং আরও বলেন, 'মিয়ানমারের জনগণের ইচ্ছায় এবং দেশটির সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে চীন সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। দেশটিতে চলমান উত্তেজনা নিরসনে চীন গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে চায়।' গত ১ ফেব্রম্নয়ারি অভু্যত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতার দখল নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। সেনা অভু্যত্থানের পরপরই এর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ গণবিক্ষোভে শুরু করেছে। পশ্চিমা দেশগুলো সেনা অভু্যত্থানের কঠোর নিন্দা জানিয়ে দ্রম্নত অং সান সু চিসহ তার দলের আটক নেতাদের মুক্তি এবং বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বলেছে। নতুবা মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চীন অভু্যত্থানের বিষয়ে কিছুই বলছে না। বরং তারা প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সেটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুঞ্জন রয়েছে, মিয়ানমারে সেনাঅভু্যত্থানের পেছনে চীনের হাত রয়েছে। এই গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেনা অভু্যত্থানের পর মিয়ানমারে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, 'চীন নিশ্চিতভাবেই এমনটা দেখতে চায়নি'। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে এক বিবৃতিতে সু চি এবং বাকি নেতাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং জরুরি অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যার সঙ্গে চীনও একমত পোষণ করেছে।