বিবিসি প্রতিবেদন

পাঁচ কারণে ভেঙে পড়েছে লকডাউন

প্রকাশ | ০৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার আরোপিত বিধিনিষেধ মাত্র দুই দিন পরেই ভেঙে পড়েছে। সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এই বিধিনিষেধকে 'লকডাউন' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু দৃশ্যত প্রথম দিন থেকেই কোথাও লকডাউনের লেশমাত্র ছিল না। মার্কেট ও দোকানপাট খোলা রাখার দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। কোথাও কোথাও এই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আরোপিত বিধিনিষেধের কোনো কোনোটি থেকে সরকার পিছু হটেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক অবশ্য সাংবাদিকদের বলেছেন, 'লকডাউন কার্যকর করার জন্য সরকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কঠোর হতে চায়নি। জনগণ যাতে সচেতন হয় সে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।' সরকার এই বিধিনিষেধগুলো কার্যকর করতে পারল না কেন, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষজ্ঞরা কিছু কারণ উলেস্নখ করেছেন। ১. বাস বন্ধ, প্রাইভেট কার চালু : সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অনুযায়ী বিধিনিষেধ কার্যকরের প্রথম দিন থেকে গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা গেছে শহরজুড়ে প্রাইভেট কার চলছে। এ ব্যবস্থাকে একটি বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পরিবহণ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পরিবহণ শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, 'লকডাউন' দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে যে 'লকডাউন' দেওয়া হয়েছিল সেটি প্রায় দুই মাস চলেছে নানা বিধিনিষেধের আওতায়। এজন্য এবার সে ধরনের পরিস্থিতি মেনে নিতে একবারেই রাজি ছিলেন না পরিবহণ শ্রমিকরা। ফলে দুই দিনের মাথায় সরকারও বাধ্য হয়েছে শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলে অনুমতি দিতে। হ পৃষ্ঠা ২ কলাম ২ সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, 'মানুষের যাতে অফিসে যেতে সুবিধা হয় সেজন্য শর্তসাপেক্ষে বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।' ২. কারখানা খোলা, মার্কেট বন্ধ গার্মেন্ট কারখানাগুলো বরাবরই অন্যসব সরকারি বিধিনিষেধের আওতার বাইরে ছিল। ২০২০ সালের লকডাউনেও যখন সবকিছু বন্ধ ছিল, তখন গার্মেন্ট কারখানাগুলো খোলা রাখা হয়। এবারও শুরু থেকেই গার্মেন্টসহ শিল্পকারখানাগুলো বিধিনিষেধের বাইরে ছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় দোকানের কর্মচারীরা যে বিক্ষোভ করেছে সেখানে তাদের অন্যতম যুক্তি ছিল, যেখানে সব শিল্পকারখানা খোলা আছে সেখানে শুধু মার্কেট-শপিংমল বন্ধ করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কীভাবে থামানো যাবে? তাছাড়া গত বছর লকডাউনের কারণে ঈদ এবং পহেলা বৈশাখের কেনাকাটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবারো সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এজন্য দোকানিরা উদ্বিগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, 'এ ধরনের সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক। কিছু খোলা রেখে কিছু বন্ধ রেখে তো হয় না। এটা তো পুরোপুরি বৈপরীত্য। সবকিছু বন্ধ থাকলে মানুষ তখন উদাহরণ দেখাত না, অজুহাত খুঁজত না।' ৩. অফিস খোলা, পরিবহণ বন্ধ সরকারি বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব সরকারি-বেসরকারি অফিস শুধু জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে বেশির ভাগ অফিসের নিজস্ব কোনো পরিবহণ ব্যবস্থা নেই। একদিকে অফিস খোলা এবং অন্যদিকে রাস্তায় গণপরিবহণ নেই। এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতে বহু টাকা খরচ হচ্ছে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভও তৈরি হয়। ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শারমিন আহমেদ বলেন, 'অফিস খোলা রাখল কেন? পরিবহণ যখন বন্ধ করেছিল তখন তো অফিসও বন্ধ রাখা উচিত ছিল।' ৪. বইমেলা খোলা, ক্ষুদ্র ব্যবসা বন্ধ এবারের লকডাউনে যে বিষয়টি অনেককে বিস্মিত করেছে, সেটি হচ্ছে ঢাকায় বইমেলা চালু রাখা। একদিকে বইমেলা চালু রাখা হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন দোকান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও রয়েছেন যারা দৈনন্দিন রোজগারের ওপর নির্ভর করেন। ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে, বইমেলা চালু রাখলে যদি সংক্রমণ না বাড়ে তাহলে কি তাদের ব্যবসা চলমান থাকলে সংক্রমণ বাড়বে? পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ড. শারমীন ইয়াসমিন বলেন, 'এ ধরনের সিদ্ধান্ত খুবই সাংঘর্ষিক হয়েছে। কথার সঙ্কে কাজের কোনো মিল নেই। এগুলো নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে।' ৫. সরকারি অফিস সীমিত, বেসরকারি অফিস পুরোদমে সরকারি প্রজ্ঞাপনে যদিও বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল দিয়ে কাজ করাবে। প্রকৃতপক্ষে বেসরকারি অফিসগুলোর জন্য এই নির্দেশনা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ফলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের মনে বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতির অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, 'লকডাউন নিয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা ছিল না বলে তার মনে হয়েছে।' সূত্র :বিবিসি বাংলা