শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বাঁধের ৩৭ স্থানে ভাঙন

নামেই শুধু উপকূলের বেড়িবাঁধ

আলতাব হোসেন, ঢাকা ও শাকিলা ইসলাম জুঁই, সাতক্ষীরা
  ০৯ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
সাতক্ষীরার শ্যামনগরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূল রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে -যাযাদি

আকাশে কালো মেঘ দেখলেই আঁতকে ওঠেন উপকূলের মানুষ। দুর্যোগ-দুর্বিপাক প্রতি বছরই আঘাত হানে দেশের বিভিন্ন উপকূলে। আসে আম্পান, সিডর ও আইলার মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। প্রতি বছর ঝড়-তুফান ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলবাসীকে তাড়া করে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে বেড়িবাঁধের সক্ষমতার ওপর। প্রায় বছরই বাঁধ ভেঙে তাদের সব কিছু ভেসে যায়। বাড়িঘর ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই এখন নাজুক হয়ে পড়েছে। এখন নামেই আছে উপকূলের বেড়িবাঁধ। বর্ষার আগেই সামান্য জোয়ারে বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে পড়েছে জনপদে।

উপকূল জুড়ে দুর্যোগের মৌসুম শুরু হয় ১৫ মার্চ থেকে। ঝুঁকির এই মৌসুম শেষ হয় ১৫ অক্টোবর। এরইমধ্যে পূর্ণিমার জোয়ারে কয়েকটি স্থানে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর-ফসলি মাঠ। গত এক সপ্তাহে উপকূল রক্ষা বাঁধের অন্তত ৩৭ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাতক্ষীরার শ্যামনগরে উপকূল রক্ষা বাঁধের প্রায় দশ কিলোমিটার অংশের ২৭টি স্থানে মারাত্মক ভাঙন দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করা এবং চিংড়ির ঘেরে লবণপানি প্রবেশ করাতে বাঁধে ছিদ্র করার কারণে ভাঙন বেড়েই চলেছে। শ্যামনগরের কাশিমাড়ি, গাবুরা ও বুড়িগোয়ালিনী উপকূল রক্ষা ভাঙন এখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। জোয়ারের আঘাত আর স্থান বিশেষে চরের মাটি দেবে যাওয়ায় বাঁধ একেবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানে পানি তোলার কল বসিয়ে নদীর লবণপানি ওঠানামা করানো হচ্ছে। এতে কয়েকটি স্থানে রীতিমতো হাঁটা রাস্তায় পরিণত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের অন্তত ৪৮২ কিলোমিটার বাঁধ। এ অবস্থায় উত্তাল নদী কিংবা আকাশে মেঘ দেখলেই ভাঙন আতঙ্কে আঁতকে উঠে উপকূলের মানুষ।

বেড়িবাঁধ সংস্কার ও মেরামতের নামে প্রতি বছর সরকারি অর্থের হরিলুট হয়। বর্ষায় তড়িঘড়ি করে কাজ করার কারণে টেকসই স্থায়ী শক্তিশালী বাঁধ হয় না। সামান্য জোয়ারে বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম পস্নাবিত হয় প্রতি বছর। অরক্ষিত উপকূলীয় এলাকার প্রায় সাড়ে চার কোটিরও বেশি মানুষ চরম ঝুঁকিতে থাকেন। এখন আর ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চান উপকূলবাসী।

মঙ্গলবার থেকে সাতক্ষীরার উপকূলীয় আশাশুনি এবং শ্যামনগর উপজেলার কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও চুনা নদীর প্রবল জোয়ারের কারণে বেড়িবাঁধে ব্যাপক ফাটল ও ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন

\হবোর্ডের প্রায় ১৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ইতোমধ্যে নদীর প্রবল জোয়ারে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দুর্গাবাটি ও দাঁতনেখালী খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে দুর্গাবাটি এবং দাঁতনেখালি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। আশাশুনি উপজেলা সদরের দয়ারঘাট এলাকাসহ মোট পাঁচটি পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙে মোট চারটি গ্রাম পস্নাবিত হয়েছে। চিংড়িঘের ও ছোট বড় পুকুর ভেসে গেছে। কয়েক হাজার বসতবাড়ি ও খাল-বিল এবং ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে আছে। ভেঙে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের দয়ারঘাট স্পটটি বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া শ্যামনগরের খোলপেটুয়া নদীর পশ্চিম দুর্গাবাটি, দাঁতনেখালী বাঁধগুলো জিওব্যাগ ফেলে পানি আটকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদাররা। ফলে দিনে কমপক্ষে দু'বার নদীর জোয়ারের নোনা পানি ঢুকছে লোকালয়ে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পানির চাপ ও বাতাসের গতিবেগ বাড়লে শ্যামনগরের ৫ ও ১৫ নম্বর পোল্ডার দুটির বিভিন্ন অংশ পাশের খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ ও আড়পাঙ্গাশিয়া নদ-নদীতে ধসে পড়বে। ৫ নম্বর পোল্ডারের ঝাঁপালি ও ঘোলা এলাকার ৯৫০ মিটার অংশ যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হতে পারে। এছাড়া পশ্চিম দুর্গাবাটির দুটি স্থানে এক হাজার ৪০০ মিটার, কৈখালীর ৫০০ মিটার, কালিঞ্চির ৬০০ মিটার, সিংহতলী ও কদমতলার ৪০০ মিটার এবং দাঁতনেখালী ও বিড়ালাক্ষীর সাড়ে ৭০০ মিটার বাঁধও বিলীনের অপেক্ষায়। অন্যদিকে ১৫ নম্বর পোল্ডারের চকবারার ৫০০ মিটার, কালীবাড়ি, গাবুরা ও পার্শ্বেমাড়ির এক হাজার মিটার এবং জেলেখালী অংশের এক হাজার মিটার বাঁধ মারাত্মক ভাঙনের মুখে পড়েছে। তবে ভেটখালীর শেখবাড়ি, কদমতলা, দাঁতনেখালী, পশ্চিম দুর্গাবাটি, নয় নম্বর, নাপিতখালী, ঝাঁপালিসহ নয়টি স্থানের প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশ সংস্কার কাজ শুরু করছে পাউবো। এদিকে পটুয়াখালী জেলার ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৫ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার হয়নি। পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, জেলার বারটি পোল্ডারের অধীনে মির্জাগঞ্জ, গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় ৬০ কিলোমিটার বাঁধ এখনো অরক্ষিত।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-দুই এর তথ্য মতে, আশাশুনি উপজেলাসহ ৭/১ ও ৭/২ পোল্ডার চারের আওতায় মোট ৪২৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে স্থানভেদে ৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এ বিষয়ে আশাশুনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম জানান, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য বার বার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের। ২৯ মার্চ কপোতাক্ষ নদের প্রবল জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পেয়ে চরম ঝুঁকিতে থাকা আশাশুনি উপজেলা সদরের দয়ারঘাট ও জেলেখালী এলাকা মুহূর্তের মধ্যে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা পস্নাবিত হয়। এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আশাশুনি সদরের খোলপেটুয়া নদীর দয়ারঘাট, জেলেখালী, বলাবাড়ীয়া প্রতাপনগর ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের কুড়িকাউনিয়া, চাকলা, শুভাদাকাটি, হিজড়াকুলা ও হরিষখালী, আনুলিয়া ইউনিয়নের মনিপুর, বিছট, খাজরা বাজার ও শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী, গরালি এবং বড়দলের কেয়ারগাতি এলাকা। অচিরেই এসব বাঁধ সংস্কার না হলে এই বর্ষা মৌসুমের মধ্যেই নদীর প্রবল জোয়ারে বাঁধ ভেঙে পস্নাবিত হবে লোকালয়ের লাখ লাখ মানুষ। ভেসে যাবে কোটি কোটি টাকার চিংড়ি ঘের।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড-দুই এর নির্বাহী প্রকৌশলী শুধাংশু কুমার সরকার যায়যায়দিনকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড-দুই এর চার নম্বর পোল্ডারের আওতায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো এক কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরোদমে বাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। নদীর জোয়ারের পানিতে গত মঙ্গলবার ভেঙে যাওয়া দয়ারঘাট বাঁধটি ইতোমধ্যে সংস্কার করা হয়েছে। দ্রম্নত গতিতে চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলমও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল ও কলবাড়ী গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-একের আওতায় ১৫ নম্বর পোল্ডারের অধীনে চারিদিকে নদী বেষ্টিত ব-দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পরে বেশ কিছু স্পটে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ সংস্কারের কাজ করে। কিন্তু কালিবাড়ী, ট্যাকেরহাট, পাশ্মেমারি, জেলেখালি বেড়িবাঁধ এখনো রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। এছাড়া বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম দুর্গাবাটি, দাঁতনেখালী আজিজ ম্যানেজারের বাড়ি হতে প্রায় এক কিলোমিটার ও শাহ-আলম গাজীর বাড়ির সামনে থেকে গাবুরা-বুড়িগোয়ালিনী কলেজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এবং বুড়িগোয়ালিনী ও আটুলিয়া ইউনিয়নের মাদিয়া ও ভামিয়া এলাকার এক কিলোমিটার বাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট ক্যাম্পের সামনে থেকে বুড়িগোয়ালিনী বাজার পর্যন্ত এবং মুন্সীগঞ্জ বাসস্টান্ড থেকে মৌখালী পর্যন্ত তিন কিলোমিটার বাঁধে ভাঙন ও ব্যাপক ফাটল রয়েছে।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের যায়যায়দিকে জানান পাউবো-১ এর অধীনে সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর এ চারটি উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ফণি ও আম্পান পরবর্তী দুই কোটি ২৪ লাখ টাকার বাঁধ সংস্কার করা হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী একেএম ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য তিনটি ফোল্ডারের প্রকল্প জমা দেওয়া আছে। এরমধ্যে একটি একনেকে পাশ হয়েছে। বাঁধ পুনঃসংস্কার এবং পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। সুন্দরবন উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার উপকূলীয় বাঁধ সংস্কার কাজ চলমান আছে। উপকূলের অন্যান্য এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ দাতাসংস্থাগুলোর সঙ্গে অর্থায়নের বিষয়ে কাজ চলছে।

স্থানীয় বাসিন্দরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে স্থায়ী ও মজবুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। যার নিচে ১০০ ফুট, ওপরে ৩০ ফুট এবং যার উচ্চতা হবে ৩০ ফুট। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরি তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকার বিভাগকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ওয়াপদা বাঁধের ১০০ মিটারের মধ্যে চিংড়ি বা কাঁকড়ার ঘের না করার নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হবে। বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় বাঁধগুলোর নকশা ১৯৬০ থেকে ৬৫ সালের। সমতল থেকে বাঁধগুলোর উচ্চতা ১০ ফুট। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস ছিল। ফলে বাঁধগুলো শতভাগ পানি আটকাতে পারেনি। তাই বাঁধগুলো উঁচু করতে হবে। আর ত্রাণ নয়, টেকসই বেড়িবাঁধ চান উপকূলবাসী।

পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক যায়যায়দিনকে বলেন, বর্ষার আগেই উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করতে সরকার কাজ করছে। বাঁধে বৃক্ষরোপণও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজ কিছুটা পিছিয়েছে। তিনি জানান, সারা দেশে ১৭ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে ৭ হাজার বেড়িবাঁধ উপকূলীয় এলাকায়। এগুলো পুরনো হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে গেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে