খুলেছে দোকান-বিপণিবিতান

ভিড় না বাড়তেই স্বাস্থ্যবিধি উধাও

প্রকাশ | ১০ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিউমার্কেট এলাকায় ক্রেতারা
করোনায় কাবু গোটা দেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার অবস্থা ভয়াবহ। অথচ এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের মুখে সরকার মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতান খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনার অঙ্গীকার করলেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের অসচেতনতায় তারা তা রক্ষা করতে পারেননি। ফলে মার্কেট খুলে দেওয়ার প্রথম দিন শুক্রবার ক্রেতার ভিড় না থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি ছিল উধাও। সচেতন ক্রেতারা জানান, রাজধানীর বেশির ভাগ মার্কেটেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদাসীনতা দেখা গেছে। মার্কেট কমিটির চাপের মুখে ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীরা অনেকে মুখে মাস্ক পরলেও কিছুক্ষণ পর পর তা খুলে ফেলছেন। প্রায় কারও মধ্যেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রবণতা নেই। সবমিলিয়ে মার্কেটগুলোতে আগের চিত্রই বিরাজ করছে। ক্রেতার চাপ না বাড়তেই যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে রমজানের শুরুতে উপচেপড়া ভিড় জমে উঠলে ঢাকার মার্কেটগুলোই করোনা সংক্রমণের 'হটস্পট' হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুক্রবার নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দোকানের পাশাপাশি হকাররা সড়কের ধারে বসে পণ্য বিক্রি করছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ হকাররা বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ঘুরছে। ক্রেতাদের উপস্থিতিও একেবারে কম নয়। সবমিলিয়ে সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে কেনাকাটা করা ছিল অনেকটাই অসম্ভব। স্বল্পসংখ্যক ক্রেতার মুখে মাস্ক থাকলেও তপ্ত দুপুরে অনেকেই তা খুলে ফেলেন। নিউমার্কেটের ঠিক সামনের এলাকায় ওভারব্রিজের অবস্থা ছিল আরও ভয়ংকর। এর এক পাশ দখল করে হকাররা বসে আছে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য ঠাসাঠাসি করে অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে উঠছিলেন ওভারব্রিজে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কোনো সুযোগ ছিল না। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকাতেও শুক্রবার সকাল থেকে একই চিত্র দেখা গেছে। হকাররা ডেকে ডেকে পণ্য বিক্রি করছেন; ক্রেতারা গায়ে গা লাগিয়ে তা কিনছেন। মার্কেটের ভেতরে পা ফেলার উপায় নেই। রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকানগুলো থেকে মানুষ বিভিন্ন খাবার কিনে খাচ্ছে। দুপুরে কোনো কোনো খাবারের দোকানে এতটা বেশি ভিড় ছিল, সিট পাওয়ার জন্য অনেককে ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে। টানা চার দিন বন্ধ থাকার পর শুক্রবার নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেট খোলার পর পাইকারি ক্রেতাদের পাশাপাশি খুচরা ক্রেতারা সেখানে ভিড় জমিয়েছেন। মার্কেটে ঢোকার মুখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে কিছুটা সতর্কতা দেখা গেলেও ভেতরের অবস্থা ছিল যথেষ্ট ঢিলেঢালা। শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখেই অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতাকে বেচাকেনা করতে দেখা গেছে। মুখে মাস্ক থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নাক ঢাকেনি অনেকেই। কেউ কেউ আবার মার্কেটের ভেতরে ঢুকেই মাস্ক খুলে হাতে নিয়ে ঘুরেছেন। পলওয়েল মার্কেটে পাইকারি মাল কিনতে আসা একজন ক্রেতা বলেন, সবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তাঘাটেই শুধু করোনা-মার্কেটে কিছু নেই। তাই সবাই মার্কেটে ঢুকেই মাস্ক খুলে রাখছেন। মার্কেট কমিটির এ বিষয়টি মনিটর করা উচিত বলে মনে করেন ওই পাইকারি ক্রেতা। এদিকে শুধু পলওয়েল মার্কেটই নয়, রাজধানীর শান্তিনগর কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি, মালিবাগ আয়েশা শপিং কমপেস্নক্স ও বেইলি রোডের বেইলি স্টার শপিং কমপেস্নক্সসহ প্রায় এক ডজন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, মার্কেটে প্রবেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও ভেতরে তা প্রায় উপেক্ষিত। করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ে বেশির ভাগ ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। সবাই যেন দায়ে পড়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিধিনিষেধ মেনে চলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনীহা দেখা গেছে। তবে বড় শপিংমল ও ব্র্যান্ড শপগুলোতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট কড়াকড়ি ছিল। সেখানে ঢোকার আগে হাতে জীবাণুনাশক ব্যবহার, শরীরের তাপমাত্রা মাপা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভেতরে চলাচল ও কেনাকাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দোকান কর্মচারীদের সবার মুখেই নিয়মমাফিক মাস্ক পরা ছিল। ক্রেতারা কেউ মার্কেটে ঢুকে মাস্ক খুলে ফেলছেন কিনা তা নজরদারিতেও বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। অনেক মার্কেটে সিসি ক্যামেরা দিয়ে তা মনিটর করা হচ্ছে। যদিও এ ধরনের ব্র্যান্ড শপ ও মার্কেটগুলোতে শুক্রবার ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম ছিল। কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্রেতার ভিড় বাড়লেও তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করবেন। গাউছিয়া মার্কেটের একাধিক দোকানি জানান, শুক্রবার সকালে দোকান খোলার পর খুচরা ক্রেতাদের পাশাপাশি পাইকারি ক্রেতারাও মার্কেটে আসতে শুরু করেন। তবে সকালের দিকে বেচাকেনা তেমন জমেনি। চার দিন পর মার্কেট খোলার পর হুট করে ব্যবসা জমে উঠবে, এমনটা তারাও আশা করছেন না। তাদের ধারণা, আরও দুই একদিন পর থেকে ক্রেতার ভিড় বাড়বে। তবে দুপুরের পর আকস্মিক ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের কড়াকড়ি লকডাউনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মার্কেট ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভিন্ন উদ্বেগ দেখা দেয়। আন্দোলন সংগ্রাম করে মার্কেট খোলার মাত্র পাঁচ দিন পর আবার বন্ধ করে দেওয়া হলে আরও সংকট তৈরি হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। ব্যবসায়ীদের ধারণা মার্কেটে ক্রেতার আগমন ঘটতে কিছুটা সময় লাগবে। এ অবস্থায় 'সর্বাত্মক লকডাউন' হলে ব্যবসায়িক মন্দা আরও বাড়বে। অবশ্য ব্যবসায়ীরা কেউ কেউ জানান, ১৪ এপ্রিল থেকে সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দুপুরে তাদের বেচাকেনা খানিকটা বেড়েছে। আগামী চার-পাঁচ দিনও বেচাকেনা ভালোই হবে। তাদের ধারণা, লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে এ আশঙ্কায় ক্রেতারা অনেকেই দেখাশোনা ও দরদামে সময় না কাটিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঈদ কেনাকাটা সারছেন। এতে ক্রেতা ও ব্যবসায়ী দু'পক্ষেরই সময় বাঁচছে। বেইলি স্টারের তৈরি পোশাক বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জানান, করোনার কারণে তার দোকানে পোশাক ট্রায়াল দেওয়ার ব্যবস্থা রাখেননি। এরপরও অনেক ক্রেতা ট্রায়াল ছাড়াই তৈরি পোশাক কিনেছেন। তবে রাজধানীর পাঞ্জাবির বৃহৎ মার্কেট মালিবাগের আয়েশা শপিং কমপেস্নক্সে গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি তেমন চোখে পড়েনি। ক্রেতাদের অনেকে একাধিক পাঞ্জাবি ট্রায়াল দিচ্ছেন। সব দোকানে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকলেও ক্রেতাদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব তেমন নেই। আয়েশা শপিং কমপেস্নক্সের সব দোকান খুবই ছোট। অধিকাংশ দোকানে ঢোকা ও বের হওয়ার পথও মাত্র একটা। ফলে ক্রেতাদের গা ঘেঁষেই দোকানে ঢুকতে ও বের হতে হচ্ছে। মার্কেটে ভিড় না বাড়তেই স্বাস্থ্যবিধি উধাও হওয়া নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ বিষয়টি আরও কঠোরভাবে মনিটর করা উচিত। তা না হলে ক্রেতারা হয়তো স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সবার জন্য ঈদের পোশাক কিনলেও এর আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পাবেন না। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চাঙা হলেও জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ প্রসঙ্গে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, জীবাণুনাশক গেট ব্যবহার, জ্বর মাপা, জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধোয়া-এগুলো হলো সাধারণ স্বাস্থ্য সতর্কতা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মার্কেটগুলোর বদ্ধ পরিবেশে একজন উপসর্গহীন করোনা রোগী প্রবেশ করলে তার হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অনেকেই আক্রান্ত হবেন। আমাদের মতো জনবহুল দেশে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বেচাকেনার বিষয়টি নীতিবাক্য ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবে এটি কখনো সম্ভব নয়।