বৈশাখী বাণিজ্যে ফের সর্বনাশ

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ঢাকাসহ সারাদেশের বৈশাখী মেলা বন্ধ থাকবে। রমনা বটমূলের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া নববর্ষের দিন থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হচ্ছে। ফলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নতুন পোশাকসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনাকাটা এবার আর হচ্ছে না। এতে বৈশাখী ব্যবসায়ীদের মাথায় রীতিমতো বাজ ভেঙে পড়েছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্দিষ্ট কোনো গবেষণা বা জরিপ না থাকলেও পোশাক থেকে শুরু করে কাঁচা ফুল, মাটির গয়না, গৃহসামগ্রী, খেলনা ও মিষ্টিসহ বৈশাখী উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা। সব খাত মিলিয়ে যার আকার অনেক সময় ২০ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। অথচ গতবারের মতো এবারও বৈশাখী বাণিজ্যে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ফ্যাশন এন্টারপ্রেনারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ মনে করে, গত বছরের মতো এবারও লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প উদ্যোক্তার মাথায় হাত পড়বে। বিশেষ করে ব্যাংক, সমবায় সমিতি ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে যারা বৈশাখী পণ্য তৈরি কিংবা মজুত করেছেন, তাদের রীতিমতো পথে বসতে হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যবসায়ীরা অনেকেই এ বছর ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কেননা জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারি মাসে যখন এ ব্যবসায় বিনিয়োগের সময়, তখন করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই সময় অনেকের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, বৈশাখ আসার বেশ আগেই দেশ থেকে এ মরণব্যাধি পুরোপুরি বিদায় নেবে। তাই যে যার মতো করে বৈশাখী বাণিজ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের চেষ্টা করেছেন। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎসবকেন্দ্রিক বেচাকেনা জমে ওঠার কথা থাকলেও ঠিক তার ক'দিন আগে থেকে প্রতিদিনই করোনা পরিস্থিতির দ্রম্নত অবনতি হচ্ছে। সম্প্রতি যা ভয়ংকর রূপ নেওয়ায় সরকার আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে দেশে 'সর্বাত্মক লকডাউন' ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। বৈশাখী ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকার পর তাদের অনেকেই অনলাইনে বেচাকেনার দিকে ঝুঁকেছেন। প্রথম দিকে কমবেশি বেচাকেনা হলেও তাতে এখন ভাটা পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক বিক্রিতে বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে বাজার-সংশ্লিষ্টরা দু'টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন, অনলাইনে বৈশাখী বাণিজ্য শুরুর পরপরই একাধিক প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা নানাভাবে ক্রেতাদের ঠকিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। এতে অনেকে অনলাইন কেনাকাটায় আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এছাড়া বৈশাখী মেলা ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বন্ধ এবং ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউনের বিষয়টিকে তারা দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে করছেন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সাধারণ মানুষ এসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্যই বৈশাখী পোশাক-পরিচ্ছদ কিনে থাকেন। কিন্তু এবার যেহেতু লকডাউনের কারণে ওইদিন মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারবেন না, তাই বৈশাখী কেনাকাটায় এখন আর কারও আগ্রহ নেই। অর্থনীতিবিদরা জানান, বর্ষবরণের উৎসব ঘিরে দেশি তৈরি পোশাকের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মেলার আগে-পরে ফুল থেকে শুরু করে মাটির গয়না, গৃহসামগ্রী, খেলনা ও মিষ্টিসহ দেশি খাবার বেচাকেনার ধুম পড়ে। গ্রামগঞ্জে ঘটা করে আয়োজন হয় বৈশাখী মেলার। দোকানে দোকানে থেকে শুরু হয় হালখাতা। সবমিলিয়ে আর্থিক লেনদেনের দিক দিয়ে রোজার ঈদের পরই পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে বড় উৎসব। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, লকডাউনের কারণে গত বছর বৈশাখী ব্যবসায়ীদের বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। তারা কেউ কেউ পুঁজি হারিয়ে একেবারে পথে বসেছেন। অনেকে ধারদেনা করে মূলধন জোগাড় করে এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ক'দিন ধরে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে এবার তাদের মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। ব্যবসায়ী এ নেতা অভিযোগের সুরে বলেন, দেশব্যাপী এই সংগঠনের ২৫ লাখ সদস্যের সবাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু তাদের ঋণ বা প্রণোদনার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খ্যাতনামা বুটিক হাউজ ওয়ার্ল্ড ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী শবনম রহমান জানান, গত বছর তার প্রায় ১৫ লাখ টাকার বৈশাখী পণ্য অবিক্রীত ছিল। যা পরে ডিজাইন পরিবর্তন করে কম দামে বিভিন্নভাবে বিক্রি করেছেন। এতে তার প্রায় ৬ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। এছাড়া সমিতির সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে তার মূলধনে টান পড়ে। অথচ এবারও কম সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে ফের সমিতি থেকে চড়া সুদে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বৈশাখী পণ্য তৈরি করেছেন। কিন্তু এখনো দুই লাখ টাকার মালও বিক্রি করতে পারেননি। শবনমের আশঙ্কা, লকডাউনের আগে কোনোভাবেই অর্ধেক পণ্যও বিক্রি হবে না। ফলে এবার তাকে মহাবিপাকে পড়তে হবে। একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে শাহবাগ মার্কেটের দোকানি আয়নাল হোসেন বলেন, 'সারা বছর আমরা নববর্ষের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। ঈদের চেয়ে এ সময়ই এখানে দেশীয় পোশাক বেশি বিক্রি হয়। অথচ গত বছরের মতো এবারও করোনার থাবায় আমাদের ব্যবসা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। লাভের আশা বাদ দিয়ে শুধু মুলধন তুলতে তিনি তৈরির খরচেই পোশাক বিক্রি করছি। তবে তাতেও শেষ কূল রক্ষা হবে কি না তা নিয়ে ভীষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছি।' বাজার-সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর মধ্যে রয়েছে সাদাকালো, আড়ং, কে ক্রাফট, অঞ্জনস, নিপুণ, প্রবর্তনা, রঙ, অন্যমেলা, বাংলার মেলা, ওজি, নবরূপা, গ্রামীণ চেক, নগরদোলা, দেশাল, নীলাঞ্জনাসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব ব্র্যান্ড ঈদ ও বৈশাখে নতুন নতুন পণ্য তৈরি করে নিজস্ব শোরুমেই বিক্রি করে। এছাড়া বড়-মাঝারি ও ছোট দেশীয় আরও বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরাসরি কাজ করে। পরোক্ষভাবে যুক্ত লোকজনের হিসাব করলে এ সংখ্যা ১৫ লাখেরও অনেক বেশি। যারা সবাই এবারও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৈশাখী বাণিজ্যে ধস নামায় দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর কর্মীদের বেতন-ভাতা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। একই সঙ্গে কারুশিল্পী ও বয়নশিল্পীদের কাজের মজুরি বাবদ বকেয়া প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধেও হিমশিম খাবে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অবস্থায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশীয় পোশাক ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তারা বলেন, এ খাতের সঙ্গে শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সরাসরি জড়িত। এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। তাই বিপুলসংখ্যক এই কর্মীবাহিনীর খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহায়তা জরুরি। এদিকে ফুল ব্যবসায়ীরাও এখন চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। তারা জানান, বৈশাখী উৎসবে বিক্রির জন্য ফুলের বাগান মালিকদের তারা অনেকেই লাখ লাখ টাকা বায়না করেছেন। এবার যেহেতু রমনায় বৈশাখী মেলা হবে না এবং পয়লা বৈশাখে রোজা শুরু হবে। তাই তাদের বিক্রি শিকেয় উঠবে। অন্যদিকে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিক্রেতারাও এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। তারা জানান, বৈশাখ এলে মাটির গয়না, পেয়ালাসহ অন্যান্য জিনিসপত্রের চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। চৈত্রের শেষ দিকে ও বৈশাখের দিনের মেলাসহ বেশ কিছু দিন খুব বেশি বিক্রি হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় মাসখানেক ধরে তাদের বেচাকেনায় অচলাবস্থা চলছে। এর উপর এবার বৈশাখী মেলা বন্ধ ও ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন থাকায় আগামীতে তাদের জন্য নতুন সংকট তৈরি হবে।