করোনার প্রভাবে অনিশ্চয়তায় ধুঁকছে দেশের শিল্প খাত

নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ নেই শিল্প উদ্যোক্তাদের এক বছরে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণে ধাক্কা

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্বে চলছে ব্যবসায় মন্দাভাব। অচলাবস্থা বাণিজ্যে। বিঘ্নিত হচ্ছে উৎপাদন। কমেছে রপ্তানি। এমন অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করছেন। ফলে ঋণ বিতরণে ভাটা পড়েছে শিল্প খাতে। কমেছে আদায়ের পরিমাণও। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগের পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। যার কারণে সাহস করে উদ্যোক্তারা নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন না। উল্টো অনেকে ক্ষতি কমাতে ব্যবসার পরিধি কমিয়ে দিচ্ছেন। মূলধনী প্রতিষ্ঠান বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির পণ্যের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। এসব কারণে কমেছে শিল্পঋণ। তার মতে, যেকোনো উপায়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। কারণ নতুন প্রতিষ্ঠান না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। সরকার ব্যবসায়িক ক্ষতি মোকাবিলায় শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতে যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাদের তদারকি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর শিল্প খাতে মোট তিন লাখ ৬১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। ২০১৯ সালে বিতরণের পরিমাণ ছিল চার লাখ ২৫ হাজার ৮২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বিতরণ কমেছে ৬৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ। তবে গত বছর মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ও প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে শিল্প খাতে \হঋণ বিতরণ যে হারে কমেছিল, শেষদিকে সরকারের বিশেষ প্রণোদনায় ঋণ প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। করোনা মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সিএমএসএমই, শিল্প ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে গত বছরের ২৫ মার্চ পাঁচ হাজার কোটি, ৫ এপ্রিল ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পরে আরও ২৩টি প্যাকেজে মোট ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো এক লাখ ৫৩৪ কোটি টাকার শিল্প ঋণ বিতরণ করেছে। আগের বছর একই প্রান্তিকে যার পরিমাণ ছিল এক লাখ ১১ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। ওই হিসাবে ডিসেম্বর প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে ১১ হাজার ৮৯ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ২০২০ সালে শিল্প খাতে বিতরণের পাশাপাশি ঋণ আদায় ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ কমে তিন লাখ ১৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকায় নেমেছে। আগের বছর যেখানে আদায় ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। মূলত করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর গত জুন ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাপকভাবে আদায় কমে যাওয়ার প্রভাবে এমন হয়েছে। জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, করোনায় বড় শঙ্কায় ঋণ বিতরণ কমে গেছে। আমানত আসছে কিন্তু ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। রপ্তানি কমেছে। উদ্যোক্তারা পরিস্থিতি না বুঝে নতুন বিনিয়োগে আসতে চাচ্ছেন না। এটা বড় চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিল্প খাতে মেয়াদি ও চলতি মূলধন হিসেবে দুই ধরনের ঋণ বিতরণ হয়ে থাকে। পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও যাবতীয় ব্যয় মেটাতে স্বল্প মেয়াদের (এক বছর বা দুই বছর) জন্য নেওয়া হয়ে থাকে চলতি মূলধন ঋণ। শিল্প খাতে বিতরণ করা এই ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, যা বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ৮০ ভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গেল বছর করোনার প্রভাবে বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে বহু কারখানা উৎপাদনে যেতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে কিছু কারখানা উৎপাদনে গিয়েছিল। যার প্রভাবে ২০২০ সাল শেষে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ হ্রাস পাওয়ার হার মেয়াদি ঋণ বিতরণের চেয়ে কিছুটা কম ছিল। গেল বছর ২০১৯ সালের তুলনায় চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। অন্যদিকে মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০২০ সালে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। জানা গেছে, নতুন কলকারখানা স্থাপন ও বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এই ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে। তাই এই ঋণ নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ডক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিনিয়োগ না হওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় শিল্প খাতে ঋণের চাহিদা কম। কোভিডের জন্য অনিশ্চিত পরিবেশে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, বছরের শেষ দিকে এসে কিছু কারখানা উৎপাদনে যাওয়ায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজের কারণে চাহিদা কিছুটা বেড়েছিল। তবে আগের পর্যায়ে যেতে অনেক সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, কর্মসংস্থান তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখে শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ। এই ঋণ কমে যাওয়া মানেই হচ্ছে নতুন শিল্প হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যায়যায়দিনকে বলেন, বর্তমানে যে হারে রপ্তানি আয় কমেছে, আগামীতেও এ অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে। রপ্তানি না বাড়লে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবে কোথায়। এছাড়া ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে তা থেকেও উদ্যোক্তারা অর্থ পাচ্ছেন না। এসব কারণে শিল্প খাতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে নতুন করে রপ্তানি হচ্ছে না। রপ্তানি কমে গেছে এ কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা হচ্ছে না। করোনার কারণে বিশ্ববাজারে মন্দা, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়া ও প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পেরে না ওঠার অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। এ কারণে নতুন করে বিনিয়োগ করার চিন্তা-ভাবনা করছে না শিল্পের উদ্যোক্তারা। তাহলে ব্যাংকের বিনিয়োগ যাচ্ছে কোথায়, এমন প্রশ্নের জবাবে দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক বলেন, শিল্প খাতের ঋণের পরিবর্তে বেশি মুনাফার আশায় সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডেই বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়ে পড়েছে ব্যাংকগুলো। কারণ সরকারকে ঋণ দিলে এখনো ১০ শতাংশের কাছাকাছি মুনাফা পাওয়া যায়। আর সরকারকে ঋণ দেওয়াটা ব্যাংকগুলোর জন্য নিরাপদ বিনিয়োগ। কারণ এখানে খেলাপি ঋণ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। শিল্প খাতের ঋণের চাহিদা কম থাকায় এখন ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল বন্ডেই বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে।