শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টিসিবির পণ্য ক্রয়ে ভিড় বাড়ছে উপেক্ষিত হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি

সাখাওয়াত হোসেন
  ১২ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
টিসিবির স্বল্পমূল্যের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। ছবিটি রোববার বগুড়ার সার্কিট হাউসের সামনে থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

একদিকে করোনার ভয়াল থাবা। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি। এই পরিস্থিতিতে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেলের পণ্য এখন অনেকেরই ভরসা। আগে শুধু নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষকে টিসিবির পণ্য কেনার লাইনে দেখা গেলেও, এখন নিম্নবিত্ত; এমনকি মধ্যবিত্তদেরও দেখা যাচ্ছে। তারা পণ্য কেনার সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সংগ্রহ করছেন কাঙ্ক্ষিত পণ্য। ঢাকাসহ সারা দেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পণ্য কিনতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ।

টিসিবির ডিলাররা বলছেন, গত বছর করোনা শুরুর পর বাজারে জিনিসপত্রের দাহু হু করে বাড়লেও সে সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকসেলে হুমড়ি খেয়ে পড়েনি। অথচ এবার লকডাউন শুরুর পর থেকেই ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। আগের তুলনায় ভিড় এতটা বেড়েছে যে, দুপুর গড়ানোর আগেই তাদের কাছে থাকা চিনি-তেলসহ সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো সময় আরও কআেসছে। ক্রেতাদের চাহিদা ও উপস্থিতির তুলনায় সরবরাহ কথাকায় পণ্য দিতে হিমশিখাচ্ছেন ডিলাররা।

টিসিবির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, পণ্য বিক্রি মনিটর করতে গিয়ে তারা দেখেছেন, মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির পণ্যের প্রতি ঝুঁকছেন। ট্রাকসেলের দীর্ঘ লাইনে বিপুলসংখ্যক মধ্যমআয়ের মানুষ দাঁড়াচ্ছেন। তাদের মতে, রিকশাচালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষ তাদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়ে সংসার চালাতে পারলেও বেসরকারি চাকরিজীবী ও দোকানিসহ যারা মধ্যমআয়ের মানুষের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। তাই বাধ্য হয়ে সংকোচ কাটিয়ে টিসিবির পণ্য কিনতে বিভিন্ন সড়কে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।

মুগদা বিশ্বরোডে ট্রাকসেলের লাইনে দাঁড়ানো মধ্যবিত্ত ঘরের একজন গৃহিণী জানান, তার স্বামীর মৌচাক মার্কেটে একটি তৈরি পোশাকের দোকান রয়েছে। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায় মারাত্মক

মন্দা চলছে। এর উপর ৫ এপ্রিল থেকে অঘোষিত লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় তারা চরবিপাকে পড়েছেন। এছাড়া শবেবরাতের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই চাল-ডাল-আটাসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাবেড়ে তা আকাশচুম্বি হয়ে উঠেছে। কারণে কিছুটা সাশ্রয়ের আশায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা ওএমএসএর লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুগদা, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মীরবাগ, মধুবাগ ও রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, খোলাবাজারে ট্রাকে করে বিক্রি করা পণ্য কিনতে প্রতিটি লাইনে এক থেকে দেড়শ' মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। অধিকাংশ স্থানে নিম্নআয়ের মানুষের তুলনায় মধ্যআয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। পণ্য কিনতে আসা লোকজনের মধ্যে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব নির্ধারণে চিহ্ন থাকলেও কেউ তা মানছেন না। বেশির ভাগ মানুষই নিয়উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ সঠিকভাবে মুখে মাস্ক পরলেও অন্যদের কারও থুতনিতে, কারও গলায় তা ঝুঁলছে। আবার অনেকে পকেটে কিংবা হাতে মাস্ক ধরে রেখেছেন।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে লাইনে দাঁড়ানোর কথা কেউ বললেই অন্যরা তেড়ে এসে তাকে লাইন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এত বিধি-নিষেধের কথা চিন্তা করলে খোলা বাজারে পণ্য কিনতে কেন এসেছে- এমন প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। বেগতিক পরিস্থিতিতে সচেতন অনেককে সবকিছু মেনে জড়োসড়ো হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

টিসিবি জানিয়েছে, ১ এপ্রিল থেকে ট্রাকসেলে একজন ক্রেতা দিনে ৫৫ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ চার কেজি চিনি, ৫৫ টাকা কেজি দরে দুই কেজি মসুর ডাল, ১০০ টাকা দরে পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল এবং ২০ টাকা দরে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারছেন। এছাড়া রমজান উপলক্ষে ৫৫ টাকা দরে দুই কেজি ছোলা এবং ৮০ টাকা দরে এক কেজি খেজুর বিক্রি করা হবে। ৫০০ ট্রাকের মাধ্যপেণ্য বিক্রি চলছে। এর মধ্যে রাজধানীতে পণ্য বিক্রি করছে ১০০টি ট্রাক। বিক্রির জন্য ডিলাররা প্রতিদিন এক টন তেল, ৭০০ কেজি করে চিনি ও ডাল এবং ৪০০ কেজি ছোলা বরাদ্দ পাচ্ছেন। তবে এখনো খেজুর বিক্রি শুরু হয়নি।

রামপুরা বাজার এলাকায় ট্রাকসেলের লাইনে দাঁড়ানো উলনের বাসিন্দা নাজনীন আকতার জানান, তিনি বেলা সাড়ে ১১টার সময় লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অথচ দুপুর সাড়ে ১২টায়ও ট্রাকের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেননি। এরইমধ্যে ট্রাক থেকে জানানো হয়েছে, তাদের চিনি ও তেল ফুরিয়ে গেছে। অথচ তিনি দুইটি পণ্য কিনতেই লাইনে দাঁড়িয়েছেন। নাজনীন বলেন, বাজারে এসব পণ্যের দাকেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। তাই কষ্ট করে তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে আছেন।

একই লাইনে দাঁড়ানো নারী উদ্যোক্তা জান্নাত আরা জানান, তার নিজের একটি বুটিক শপ রয়েছে। তিনি দোকানে বিক্রির পাশাপাশি মার্কেটগুলোতে তার তৈরি পোশাক সরবরাহ করেন। লকডাউনের কারণে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ঈদের আগে ব্যবসা হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। তাই সংকোচ ভুলে চিনি, তেল ও খেজুর কেনার জন্য সকালে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়ানো বেশির ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি নিজেরা যেমন মানছেন না, তেমনি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে পাল্টা ধমক খেতে হচ্ছে। তিনি এই দুঃসময়ে মানুষকে সামান্য কদাপেণ্য দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে না ফেলার বিষয়ে টিসিবির কাছ থেকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করছেন।

টিসিবির ডিলাররাও অনেকে ক্রেতাদের ভোগান্তির বিষয়টি নিঃসংকোচে স্বীকার করে বলেন, তাদের যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হয়, তার চেয়ে দুই-তিনগুণ ক্রেতা প্রতিদিন লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। অথচ দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করতে না পেরে মানুষ গালিগালাজ করছে। এমনকি অনেক সময় তারা বিক্রেতাদের উপর চড়াও হচ্ছে। তাদের মতে, বর্তমানে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত মানুষ যেভাবে টিসিবির লাইনে এসে ভিড় করছে, তাতে তেল ও চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ দ্বিগুণ বাড়ানো উচিত। ডিলাররা মনে করেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাযেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামীতে ট্রাকসেলের লাইনে ভিড় আরও বাড়বে। আগের মতো একই পরিমাণ পণ্য দেওয়া হলে ক্রেতাদের ভোগান্তি বাড়বে।

তবে অনেকের অভিযোগ, টিসিবি থেকে ডিলারদের যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হচ্ছে তার সবটুকু লাইনে দাঁড়ানো মানুষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে না। ডিলাররা অনেকে গোপনে তা কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণে বেশির ভাগ ডিলার নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে পণ্য বিক্রি করেন না। তারা তাদের খেয়াল-খুশিমতো একেক দিন একেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পণ্য বিক্রি করছেন। ক্রেতাদের অভিযোগ বেশির ভাগ এলাকায় বিকালের দিকে ট্রাক থাকে না। আবার অনেক জায়গায় বিক্রিই শুরু করা হয় দুপুরের পর। এমন অভিযোগের বিষয়ে বিক্রয়কর্মীরা জানান, পণ্যের চাহিদা বেশি থাকায় বিকালের আগেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। তাছাড়া ডিলাররাও অনেক সময় অনিয়করে থাকেন।

টিসিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর যায়যায়দিনকে বলেন, বিষয় মনিটরে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত টিরয়েছে। তারা প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক মনিটরিং করেন। কোনো ডিলারের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে