করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন

বাঙালির নববর্ষ আজ

প্রকাশ | ১৪ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

আলতাব হোসেন
'এসো হে বৈশাখ এসো এসো... মুছে যাক গস্নানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।' পয়লা বৈশাখের চিরায়ত এই গান আকাশে-বাতাসে গুঞ্জরিত হলেও এবারে তার প্রকাশ ভিন্ন। বাংলাদেশসহ বিশ্বে চলছে মহামারি করোনা। তারপরও নতুন বছর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। এবারের বৈশাখ নিশ্চয়ই করোনাভাইরাস মুক্ত নতুন বিশ্বের স্বপ্ন নিয়ে আসবে। মহামারি থেকে মুক্তির আশা নিয়েই বাঙালি নতুন বছরকে বরণ করে নেবে কোনো আড়ম্বরপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। পাশাপাশি নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি আজ আরও সোচ্চার হয়ে উঠবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আজ বুধবার পয়লা বৈশাখ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। আজ শুধুই বাঙালিয়ানায় মেতে ওঠার দিন, সার্বজনীন উৎসবের দিন। নিজেদের ঐতিহ্য, নিজেদের সংস্কৃতিকে ধারণ করার এমন দিনে বর্ণিল উৎসবে মেতে ওঠার কথা দেশ। রাজধানী জুড়ে থাকার কথা মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বর্ষবরণের নানা আয়োজন। তবে করোনার কালো ছায়ায় এবারও বিবর্ণ বৈশাখ। এবার ঐতিহ্যবাহী রমনার বটমূলে হচ্ছে না ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তবে ভার্চুয়ালি এ অনুষ্ঠানটি হবে। যা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও নেই বৈশাখীর কোনো আয়োজন। তারপরও আজ যে বাঁশি বাজবে নগরে বা গ্রামীণ প্রান্তরে তার সুর অমলিন। বাঙালির প্রাণ থেকে নিঃসরিত হবে, মিশে যাবে হাজার বছর ধরে এই বাংলায় আমাদের প্রপিতামহদের বাজানো বাঁশির সুরে। আজ মাটির টানে ফিরবে সবাই বাঙালির শেকড় সন্ধানে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে দেশবাসীসহ বাঙালিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। নববর্ষ বাঙালির এক আনন্দ-উজ্জ্বল মহামিলনের দিন। আনন্দঘন এদিনে রাষ্ট্রপতি দেশে-বিদেশে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সকল অশুভ ও অসুন্দরের ওপর সত্য ও সুন্দরের জয় হোক। ফেলে আসা বছরের সব শোক-দুঃখ-জরা দূর হোক, নতুন বছর নিয়ে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি এ প্রত্যাশা করি। নববর্ষ উপলক্ষে এক বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'পহেলা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, বাঙালির মহামিলনের দিন। এদিন সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে সবাইকে আজ নব-আনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানাই।' মঙ্গলবার ছিল ৩০ চৈত্র, ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শেষ দিন। চৈত্র মাসের এই দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। বাংলার বিশেষ লোকজ উৎসব এই চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসে এ দিনটি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরনোকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য চৈত্রসংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে গত বছরের মতো এবারও চৈত্রসংক্রান্তিতে ছিল না কোনো আনুষ্ঠানিকতা। কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন গণনার শুরু মোঘল সম্রাট আকবরের সময়ে। হিজরি চন্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় বাংলা সন। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলার্বষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরে সব কিছু প্রতিহত করে উড়বেই শুভ-সুন্দরের বিজয় কেতন, এমন আশাবাদ খাঁটি বাঙালিদের। এদিকে আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) প্রতিনিধি জানান, ভার্চুয়ালি চৈত্রসংক্রান্তি ও বসন্ত উৎসব উদযাপন করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (জবিসাক)। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় জবিসাকের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রম্নপে তা সম্প্রচার করা হয়। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি মো. ফাইয়াজ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাঈদ মাহাদী সেকেন্দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বজলুর রশীদ খান। ভার্চুয়াল এ উৎসবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মীদের গান, নৃত্য এবং আবৃত্তি প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নববর্ষ উপলক্ষে নানা আয়োজন করে ভার্চুয়াল পস্ন্যাটফরমের মাধ্যমে।