করোনার মৃদু উপসর্গ নিয়ে গত সপ্তাহে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করান প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম। দুইদিন পর তিনি নেগেটিভ ফল হাতে পান। পরে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় একজন চিকিৎসকের পরামর্শে বুকের সিটিস্ক্যান করান। এতে দেখা যায় তার ফুসফুসের অনেকাংশই সংক্রমিত। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছেন।
একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ধানমন্ডির গৃহবধূ ফওজিয়া রহমান। তার স্বজনরা জানান, নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রেজাল্ট এলেও পরে এমআরআই করে তার ফুসফুসে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা শনাক্ত না হওয়ায় তার শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, রোগী নমুনা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহণ ক্ষেত্রের নানা দুর্বলতা বা ত্রম্নটির কারণে ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। তবে গত কয়েক মাস ধরে এ ধরনের ভুল ফল পাওয়ার পেছনে ভিন্ন কারণ রয়েছে।
তাদের অভিমত, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ ভাইরাসের অনেক জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট বা জিনগত ধরন বর্তমানে বিস্তার করেছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলীয় ধরনকে 'ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য যে প্রাইমার ব্যবহার করা হচ্ছে, তা দিয়ে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এর ফলে যেসব রোগী নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত, আরটি পিসিআর পরীক্ষায় তাদের ফল নেগেটিভ আসছে। এ কারণে অনেক রোগীর করোনা চিকিৎসা শুরুতে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটছে। আর অনেকটা এ কারণেই দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃতু্য সংখ্যা হু-হু করে বাড়ছে।
দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এ সংকট মোকাবিলায় করোনার পরিবর্তিত রূপ নির্ণয় করতে প্রয়োজনীয় প্রাইমারের নকশা পরিবর্তন করতে হবে। নতুন করোনা শনাক্তে 'থ্রি-জিন পিসিআর টেস্ট' জরুরি। কেননা 'থ্রি-জিন পিসিআর' ইউকে স্ট্রেইন শনাক্ত করতে সক্ষম।
দেশে ১১৮টি কেন্দ্রে পিসিআর পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে, সেখানে 'থ্রি-জিন পিসিআর কিট' দিয়ে দ্রম্নত সময়ে নিরীক্ষণ সম্ভব। পরবর্তীকালে এসব রোগীর জিনোম সিকোয়েন্সও করা যাবে। কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রাখা গেলে করোনার
নতুন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ধরন শনাক্তের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে আরটি-পিসিআরে 'টু-জিন' পরীক্ষা হয়। নতুন ধরন শনাক্ত করতে থ্রি-জিন পরীক্ষা করতে হবে। এই থ্রি-জিনের একটি জিন 'এস-জিন', যা স্পাইক প্রোটিনকে শনাক্ত করে। থ্রি-জিন পরীক্ষায় দুটি যদি পজিটিভ আসে, আর এস জিন নেগেটিভ আসে, তাহলে সেটাকে 'ড্রপ আউট' বলে। এর অর্থ বোঝায়, এই নমুনাটিতে ভাইরাসের পরিবর্তিত ধরন আছে। সেক্ষেত্রে পরে তা নিশ্চিত করার জন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে হবে। বাংলাদেশ চাইলেই থ্রি-জিন পরীক্ষার কিট সংগ্রহ করতে পারবে। এবং বর্তমানে এটা সংগ্রহ করে তা দিয়ে পরীক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও তাতে খরচও খুব বেশি হবে না। বরং সিকোয়েন্সিং করতে খরচ খুব বেশি। তাই যত দ্রম্নত সম্ভব থ্রি-জিন পরীক্ষার কিট এনে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন তারা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, দেশে আরও আগে থেকেই থ্রি-জিন আরটি-পিসিআর টেস্ট চালু করা দরকার ছিল। বর্তমানে যে প্রাইমারগুলো দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলো অনেক পুরনো। এগুলো দিয়ে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই এখন যত দ্রম্নত পারা যায় থ্রি-জিন টেস্ট চালু করতে হবে। যাতে করোনার যে কোনো ধরনই শনাক্ত করা যায়।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রিটেনের স্ট্রেইনের অনুরূপ করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন বা স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত হয়েছে। অথচ বিদ্যমান আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় টু জিন কিট ব্যবহৃত হওয়ায় এ পদ্ধতিতে নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত করতে পারছে না। এ কারণে টু-জিন আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে টেস্টে অনেকের নেগেটিভ রেজাল্ট মিললেও তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, অন্যান্য দেশের মতো যত দ্রম্নত সম্ভব থ্রি-জিন প্রিমার ব্যবহার করে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে থ্রি-জিন পদ্ধতির কিট আমদানির। অথচ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের খবর এখনো পাওয়া যায়নি। এতে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
তাদের ভাষ্য, স্পাইক জিন, একটি ওআরএফ-১ এবি এবং তৃতীয়টি এন-জিন হলো করোনা ভাইরাসের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি জিন। ব্রিটেনে পাওয়া নতুন স্ট্রেইনে এন-৫০১ ওয়াইয়ের প্যাথজেনিক জিনের সিকুয়েন্সের পরিবর্তন এসেছে ১৭টি। আবার স্পাইক প্রোটিনের কিছু অংশ বিলুপ্ত হয়ে পেয়েছে নতুন আকৃতি। যার কারণে এটি হয়ে উঠেছে আরও সংক্রমণশীল। ছড়াচ্ছে ৭০ ভাগ বেশি দ্রম্নতগতিতে। ব্রিটেনের মতোই এই স্থানিক বা লোকেশনে মিল আছে এমন স্ট্রেইনের উপস্থিতি বাংলাদেশেও মিলেছে। বৈসাদৃশ্য শুধু প্রোটিনের অ্যামাইনো এসিডের পরিবর্তন। বাংলাদেশে আরজিনিন অ্যামাইনো এসিড এবং ব্রিটেনে হিস্টিডিন- এই অংশটিই নিয়ন্ত্রণ করে প্রোটিনের কার্যকারিতা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, যে সিকুয়েন্সগুলো প্যাথজনিস করে অর্থাৎ ভাইরাসটিকে প্যাথজনিস করতে সাহায্য করে, সেই সিকুয়েন্সের মধ্যে ১৭টি পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রিলিজ হয়ে যাওয়ার পর যে স্পাইকটা হয়, তা বাচ্চাদের মধ্যে ওয়াইন করতে পারে। অথচ ভাইরাসের পরিবর্তন হলেও দেশে প্রচলিত শনাক্তকরণে আরটি পিসিআর পদ্ধতি বদলায়নি। আগের মতোই করা হচ্ছে টু-জিন পদ্ধতিতে। যা সব মিউটেশন বা পরিবর্তনকে শনাক্ত করতে পারছে না।
অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, আমরা যে প্রাইমারটা ব্যবহার করি সেটা হলো টু-জিন প্রাইমার। এ দিয়ে আমরা দুটি জিন দেখি কিন্তু এখন যে ভাইরাসের পরিবর্তন হয়েছে তা এটির সঙ্গে আর বাইন করবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনে প্রথমে থ্রি জিন আরটি-পিসিআর স্ক্রিনিং ও পরে সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে, সব পরীক্ষায় এস-জিন নেগেটিভ আসছে; সেখানে বাকি দুটো পরীক্ষায় জিন পজিটিভ। আবার জিনোম সিকুয়েন্সিং-এ ৯৯ শতাংশে নতুন স্ট্রেইনের উপস্থিতি মিলছে।
ঢামেকের ভাইরোলজি বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, মানুষ ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে আসছে, এখন আইসিইউতে বেশি রাশ এবং মানুষ মারাও যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মও মারা যাচ্ছে। কোন স্ট্রেইন, তা জেনে অবশ্যই টেস্ট বদলাতে হবে। কেননা আরটি পিসিআর টেস্টে নেগেটিভ ফল এলেও সিটিস্ক্যান কিংবা এমআরআই টেস্টে অনেকের মিলছে ফুসফুস সংক্রমণ।
অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, এই যে ভাইরাস, এটার উপসর্গ খুবই মৃদু। তবে হঠাৎ তাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। অক্সিজেন সাকসেশন কমে যাচ্ছে, আইসিইউতে নিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। সিটি স্ক্যান করে দেখা যাচ্ছে যে, ফুসফুসের জটিলতা। কিন্তু কোভিড টেস্ট নেগেটিভ রেজাল্ট এসেছে।