বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ মহামারিতে বাড়ছে সুষখাদ্যের অভাব

পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য মতে, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় কখাবার খায় প্রায় ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষ। শহর অঞ্চলে খাবার কেনার টাকা নেই এমন মানুষের হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর খালি পেটে ঘুমাতে যায় ৮ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ
রেজা মাহমুদ
  ০৭ মে ২০২১, ০০:০০

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা সৌরভ। গত বছর করোনায় বাধ্যতামূলক ৬ মাসের ছুটি আর বছরের কঠোর বিধিনিষেধে অর্ধেক বেতনে করছেন হোঅফিস। এদিকে মহামারির আগে গুলশানের অভিজাত একটি হোটেলে প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন আমিনুল ইসলাম। করোনার প্রথধাপেই চাকরি হারিয়ে এখন মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং করে সংসার চালাচ্ছেন। যদিও গত বছর সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে পরিবারের সবার জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আর অবশিষ্ট নেই।

দীর্ঘ মহামারিকাল সৌরভ আর আমিনুলের চাকরি ও সঞ্চয়ের সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে পরিবারের সদস্যদের সুষখাবার। চলমান মহা্‌মারিতে আমিনুল ও সৌরভের মতো কয়েক লাখ বাবা তার সন্তান ও পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, খুব প্রয়োজন না পড়লে যে কোনো অসুখে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে না এসব পরিবার।

আমিনুল জানান, বর্তমানে তিনি যা আয় করছেন তা মহামারির আগের আয়ের তুলনায় অর্ধেক। তা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সুষখাবার তো দিতে পারছে না বরং অসুখ-বিসুখে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্যটুকু তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের অতি ধনী এক-চতুর্থাংশ মানুষের বাইরে সবারই আয় কমেছে করোনায়। এছাড়াও অন্যান্য বিশেষ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খাবার বাবদ ব্যয় কমাতে হয়েছে এসব মানুষকে। আয় কযোওয়ায় অনেক পরিবার খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে বলে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এসব গবেষণা বলছে, খাদ্য তালিকা থেকে অনেকই আমিষ, ফল বা অন্যান্য উপকরণ বাদ দিচ্ছেন। অনেক পরিবারে সাধারণ খাবারও কখাওয়া হচ্ছে। আর খালি পেটে ঘুমাতে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর 'আরবান সোসিও-ইকোনমিক সার্ভে'র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ খাবার ব্যয় কমিয়ে মহামারিকালে বর্ধিত ব্যয়ের জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এছাড়াও ২২ শতাংশ পরিবার কখাবার খায়, আবার ১৭ শতাংশ পরিবার নিম্নমানের খাবার খায়। মহামারির শুরুতে এসব পরিবার স্বাভাবিক ও সুষখাবার গ্রহণ করত বলে গবেষণায় ওঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় প্রায় ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ চিন্তিত থাকেন। পছন্দের খাবার খেতে পায় না ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনের তুলনায় কখাবার খায় প্রায় ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষ। পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্য অনুযায়ী, শহর অঞ্চলে খাবার কেনার টাকা নেই এমন মানুষের হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আবার এক বেলা খাবার থাকায় খালি পেটেই ঘুমাতে যায় ৮ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ।

এদিকে খাবারের বৈচিত্র্য ও পরিমাণ কআেসায় পুষ্টি পরিস্থিতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাকাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় এসব পরিবার তীব্র অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে যে তার রিকভার করার কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে তারা আগের মতো কাজ করার শক্তি পাবেন না। আর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এই জনবল দিয়ে জাতীয় উৎপাদনশীলতা বা জিডিপির উন্নতি প্রায় অসম্ভব। এছাড়াও সুষখাবারের অভাবে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও চরমভাবে হুমকির মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ফাহমিদা রুবা যায়যায়দিনকে বলেন, শিশুদের মস্তিষ্ক ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রথ৫ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই গর্ভকালীন সময় থেকে প্রসবের দুই বছর পর্যন্ত মায়ের আর ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর সুষখাবার নিশ্চিত না হলে এসব শিশুদের মেধার বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। তারা পরবর্তীতে পড়াশুনা থেকে শুরু করে সবকিছুতে সমবয়সি অন্যান্য শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকবে। স্কুলে যখন অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না তখন শিশুসহ তার পরিবার বিষণ্নতায় ভুগবে। বিশেষ করে মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ফাহমিদা।

তিনি বলেন, অপুষ্টিতে ভোগা কোনো মেয়ে যখন শিশু থেকে কিশোরী হয়ে উঠবে তখন নানারকশারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে। রক্তস্বল্পতা হবে এসব নারীর দীর্ঘমেয়াদি জটিল সব রোগের উৎস। পরবর্তীতে সন্তান ধারণে অক্ষমতাসহ নানা ধরনের সামাজিক ট্রমায় ভুগতে হতে পারে তাদের।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ওয়েভের কারণে খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হচ্ছে। পরিস্থিতির যত অবনতি হবে, মানব সম্পদ ও জাতীয় উৎপাদনশীলতায় এর বিরূপ প্রভাব তত বাড়বে। তিনি বলেন, গত বছর করোনায় ৬৬ দিনে লকডাউনের ধকল কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবে ২০২১ সালে এর প্রকোপ বৃদ্ধি এবং দীর্ঘদিন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের খাবারের তালিকা ক্রমেই ক্ষুদ্র হচ্ছে।

এদিকে অঞ্চল ও পেশার বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা ১০ শ্রেণির মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সিটিজেনস পস্নাটফর্ম ফর এসডিজি জানিয়েছে, প্রায় ৮১ শতাংশ পরিবার করোনার কারণে খাদ্য ব্যয় কমিয়েছে। ৪৭ শতাংশের বেশি পরিবার খাবার তালিকা থেকে আমিষ বাদ দিয়েছে। খাবারে বৈচিত্র্য কমিয়েছে ৩৮ শতাংশ পরিবার। সাত শতাংশ পরিবার এক বেলা কখেয়ে থাকছে। আর ১০ শতাংশ পরিবার শিশুখাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে।

এদিকে পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকাকে কেন্দ্র করে খাদ্য বিতরণের পাশাপাশি শিশুখাদ্য বিতরণের পরামর্শ দেন তারা। নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য রেয়াতি মূল্যে চাল ডাল ও তেলের পাশাপাশি ডিম, দুধ, শিশুখাদ্য বিক্রি আর মধ্যবিত্তদের জন্য বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে