করোনার টিকা

দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে উদ্বেগ সর্বাত্মক চেষ্টা সরকারের

প্রকাশ | ০৭ মে ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে পর্যুদস্ত ভারত সব ধরনের টিকা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায়, সেরাইনস্টিটিউট থেকে কেনা তিন কোটি ডোজ কোভিশিল্ড সময়মতো বাংলাদেশে আসছে না। অবস্থায় প্রথডোজ স্থগিত করে দেশে এখন শুধুই দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারের হাতে যে পরিমাণ টিকা আছে, তাতে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ সময়মতো দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। নিয়অনুযায়ী পূর্ণ সুরক্ষা পেতে প্রথডোজের পর দ্বিতীয়টি ১২ সপ্তাহের মধ্যে নিতে হবে। এর পরে নিলে সুরক্ষা কিছুটা কেেযতে পারে। ফলে প্রথডোজ নেওয়া মানুষ চরদুশ্চিন্তায় পড়েছে। কেননা প্রথডোজ কোভিশিল্ড নেওয়ার পর, দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি কিংবা অন্য টিকা নেওয়া ঠিক হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অবস্থায় সরকার অন্য দেশের তৈরি ভ্যাকসিনের পাশাপাশি দ্রম্নততসময়ে আরও অন্তত ১৩ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনিকার কোভিশিল্ড টিকা সংগ্রহের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় ডোজের টিকা কপড়ার ঝুঁকি অনেক আগে ধরা পড়লেও সরকার প্রথডোজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট দেরি করেছে। কারণে সরকারকে এখন প্রথডোজ কোভিশিল্ড টিকা নেওয়া ১৩ লাখ মানুষকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়েছে। টিকা সংগ্রহে সরকারের দূর্বল পরিকল্পনা, বিকল্প উৎসের প্রতি কমনোযোগ এবং ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা জন্য দায়ী বলে তারা মনে করছেন। প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান বলেন, 'বিশ্বের যেসব দেশে করোনা টিকা দেওয়া হচ্ছে এমন প্রতিটি দেশই দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করে প্রথডোজ টিকা দিয়েছে। অথচ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বড় ধরনের ব্যতিক্রদেখা গেছে।' এদিকে সরকার রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ওয়াশিংটন থেকে এখনো কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি। অবস্থায় সরকার যদি রাশিয়া বা চীনের টিকা আমদানি করে, তাহলে কি সেই টিকা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত হবে কিনা; তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। কেননা দুই কোম্পানির টিকার দুই ডোজ নিয়ে সুফল ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে বৈশ্বিক কোনো গবেষণার ফল এখনো বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে নেই। যদিও বিষয়ে কোনো পরীক্ষিত ফলাফলও নেই। দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর গ্রহীতাকে যে সনদ দেওয়া হয়, তাতে দুই প্রতিষ্ঠানের টিকা গ্রহণের কথা উলেস্নখ থাকলে তা আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা নিয়েও জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। ভ্যাকসিনের দুটি ডোজের একটি স্পুটনিক-ভি এবং অপরটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দেওয়া যাবে কি-না, এর উপর একটি ফেইজ-১ ও ২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রাশিয়াতে শুরু হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ৩০ মার্চ, যা শেষ হওয়ার কথা অক্টোবরে। তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস ডট গভ. ওয়েবসাইটের তথ্যমতে ট্রায়ালটি এখনো শুরুই হয়নি। সুতরাং ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত বলা যাবে না যে, এই দুটি ভ্যাকসিনের 'মিক্স এন্ড ম্যাচ' কতটুকু কার্যকরী হবে কিংবা এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিবে কি-না। তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, যেহেতু দুটি ভ্যাকসিনই একই পস্ন্যাটফর্মের তাই মিক্স এন্ড ম্যাচ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করলে কার্যকরী হতে পারে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ সরকার অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই কোটি টিকা চাইলেও দাতা পক্ষের কাছ থেকে এখনো আশার কোনো বাণী শোনা যায়নি। ভারতকে চিঠি দেওয়া হয়েছে পুরোটা না দিতে পারলেও অবিলম্বে ৩০ লাখ ডোজ দেওয়ার জন্য। এর কোনো উত্তরও ভারতের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীনের ভ্যাকসিনের পাশাপাশি ভারত ছাড়া অন্য উৎপাদনকারী দেশের কাছ থেকে অ্যাস্ট্রাজেনিকার ভ্যাকসিন পেতে সরকারের জোরালো প্রচেষ্টার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। শিগগিরই দেশে ভ্যাকসিন সংকট কেটে যাবে বলেও জানান তিনি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি প্রস্তুতি ও জরুরি অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ভারতের সেরাইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের (টিকা) চুক্তি থাকলেও সে দেশের বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার কারণে চুক্তি অনুযায়ী সব ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে না। রাশিয়া ও চীনের টিকা পাওয়ার বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, 'ভ্যাকসিন (টিকা) নিতে রাশিয়ার সঙ্গে সরকারের কথা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে শিগগিরই চুক্তি হবে আমাদের। পাশাপাশি, চীন ১২ মের মধ্যে ৫ লাখ ভ্যাকসিন (টিকা) দিচ্ছে। চীন সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। দ্রম্নতই চীনের ভ্যাকসিন (টিকা) নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত চলে আসবে।' ভারত ছাড়া অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনকারী অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন (টিকা) ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য যে দেশগুলো উৎপাদন করছে আমরা সেই দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করছি। সব মিলিয়ে আশা করা যায়, খুব দ্রম্নতই ভ্যাকসিন (টিকা) সংকট কেটে যাবে।' এদিকে, এরই মধ্যে দেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্ম কোম্পানির ভ্যাকসিন (টিকা) জরুরি ব্যবহার ও উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যেই উপহার হিসেবে সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন (টিকা) পাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। তবে স্পুটনিক-ভি বা সিনোফার্ম টিকা কি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের (টিকা) সঙ্গে 'মিক্স এন্ড ম্যাচ' পদ্ধতিতে দেওয়া যাবে কিনা তা অমিমাংসিত রয়ে গেছে। এছাড়া স্পুটনিক-ভি বা সিনোফার্মের ভ্যাকসিনগুলো কতটা কার্যকর এবং নিরাপদ তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রসঙ্গত, স্পুটনিক-ভি বা সিনোফার্মের টিকা এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি। দুটো ভ্যাকসিন (টিকা) ইউরোপের রেগুলেটর ইএমএ, যুক্তরাজ্যের রেগুলেটর এমএইচআরঅথবা যুক্তরাষ্ট্রের রেগুলেটর এফডিকারোরই অনুমোদন পায়নি। তবুও ভারত সম্প্রতি স্পুটনিক-ভি কে তাদের দেশে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। একটা নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিন (টিকা) কতটুকু নিরাপদ এবং কার্যকর তা নিশ্চিত করে বিভিন্ন দেশের মান নিয়ন্ত্রক রেগুলেটর কমিটি। এই অনুমোদন প্রক্রিয়াটি জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। এর জন্য দরকার এক্সপার্ট প্যানেল যারা ভ্যাকসিনের সব ল্যাবরেটরি এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডাটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে তারপর ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এর জন্য দরকার কমপক্ষে তিন-চার সপ্তাহ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিভাবে এত দ্রম্নত ভ্যাকসিন দুটোকে অনুমোদন দেওয়া হলো তা নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রসঙ্গত, এরই মধ্যে প্রথডোজের টিকা নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ জন। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ জন। ২৭ এপ্রিল থেকে প্রথডোজ দেওয়া বন্ধ হওয়ায় আপাতত টিকার বাইরে থাকছেন নিবন্ধিত ১৪ লাখের বেশি মানুষ। আর ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ জনের দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।