করোনা নিয়ন্ত্রণের সব ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ছে

প্রকাশ | ১১ মে ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
নগর-বন্দরের রাস্তাঘাট, গণপরিবহণ, মার্কেট-শপিংমল, কাঁচাবাজার- সবখানেই ভেঙে পড়েছে সরকারের সব ধরনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, ঘরের বাইরে বের হলে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধানসহ সরকারের সব বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি শুধু নথিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সব কিছুই এখন সাধারণ মানুষের খেয়াল-খুশির উপর নির্ভর করছে। চলমান পরিস্থিতি এতটাই লাগামহীন হয়ে পড়েছে যে, ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মাঝেও প্রশাসন স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা মানানোর তৎপরতা চালালেই এটিকে ইসু্য বানিয়ে এক শ্রেণির মানুষ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। সবাই এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এতে তাল মেলাচ্ছে। ফলে মাঠ প্রশাসন অলিখিতভাবে বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি তুলে নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা ধরনের তৎপরতা চালাতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও তাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, মার্কেট-বিপণিবিতান ও শপিংমলের ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বেচাকেনা করার প্রতিশ্রম্নতি দিলেও ঈদ কেনাকাটা জমে উঠতেই তারা সেখান থেকে পুরোপুরি সরে এসেছে। অন্যদিকে, করোনা সংক্রমণ রোধে ঈদযাত্রার ঢল ঠেকাতে দূরপালস্নার গণপরিবহণ বন্ধ রাখা হলেও নিষেধাজ্ঞা ভেঙে অনেক রুটেই তা চলাচল করছে। স্থানীয় প্রশাসন তাতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে গণপরিবহণ শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভয় দেখাচ্ছে। অন্যদিকে সিটি সার্ভিসের বাস নগরীর অভ্যন্তরে চলাচলের সুযোগ নিয়ে অবৈধ ফায়দা লুটছে। এদিকে ২৫ এপ্রিল থেকে মার্কেট খুলে দেওয়ার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে মার্কেটে যেতে মুভমেন্ট পাস লাগবে বলে ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে সেখান থেকে তারা সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, মুভমেন্ট পাস ছাড়া মার্কেটে যাওয়া লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে বড় ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে পুলিশ এ নির্দেশনা অলিখিতভাবে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, দূরপালস্নার যাত্রা প্রতিরোধ ব্যবস্থা এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যে তারা বাধ্য হয়ে শিমুলিয়া ঘাটে বিজিবি মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তাতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। রোববার সকাল থেকে ঘাটে বিজিবি মোতায়েন থাকার পরও বিপুলসংখ্যক দূরপালস্নার যাত্রী ফেরিতে চেপে বসেছে। তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জোরপূর্বক ফেরিতে উঠে। বিজিবিকে দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এদিকে ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের মার্কেটগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। সেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ বলে কোনো বিষয় আছে, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। ছোট-বড় প্রতিটি মার্কেটেই ক্রেতা-বিক্রেতারা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে যে যার খেয়াল-খুশি মতো কেনাবেচা করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা আদায়, এমনকি মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। বরং এতে হিতে বিপরীত অবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ কার্যক্রম সীমিত করে এনেছে। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণের অসচেতনতা ও বেয়াড়াপনাকে দায়ী করছে। তবে সচেতন মহল এজন্য পাল্টা সরকারকে দুষছেন। তাদের ভাষ্য, অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণেই সরকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতি আগামীতে আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। তবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কারও কারও দাবি, জীবন-জীবিকা দুটিই একসঙ্গে চলমান রাখতে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছুটা ঢিল দেওয়া হয়েছে। তবে লাগাম তাদের হাতেই রয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে তা টেনে ধরা খুব বেশি কঠিন হবে না। এক্ষেত্রে বেশি কঠোরতা দেখালে একশ্রেণির মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হবে বলে দাবি করেন তারা। তবে তাদের এ দাবি ততটা যুক্তিযুক্ত নয় বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্য, শপিংমল, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন জনসমাগম স্পট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যে সংখ্যক মানুষ সরকারি বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ শুধুমাত্র শখের বশে ঘরের বাইরে বের হচ্ছে। এছাড়া লকডাউনে সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকতে 'ভালো লাগছে না' তাই ঘোরাঘুরি করে একঘেমেয়ি কাটাতে রাস্তায় বের হওয়া মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি বিধি-নিষেধের কড়াকড়ির মাঝেও নেহাত বেঁচে থাকার তাগিদে শুধু শ্রমজীবী মানুষই নয়; মধ্যমানের চাকরিজীবী, কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক ও টিউশনি পেশার উপর নির্ভরশীল অনেকেই যেনতেন পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি উচ্চশিক্ষিত অনেকে করোনাকালে চাকরি হারিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে এখন সিএনজি অটোরিকশা কিংবা রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। যাদেরকে বিভিন্ন সময় পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কখনো আবার ভ্রাম্যমাণ আদালতে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হচ্ছে। অথচ লাখ লাখ সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, যাদের অফিস ছুটি থাকলেও মাস শেষে ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে অটো বেতন জমা হচ্ছে, তারা বিনা কারণে বিভিন্ন জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে জড়ো হলেও তারা প্রশাসনের নজরদারির বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে, অন্যদিকে অসহায় মানুষ হয়রানি ও জরিমানার শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই এমন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ভাষ্য, এ অবস্থা চলমান থাকলে অভাবগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটার পাশাপাশি লকডাউন ও বিধি-নিষেধের কড়াকড়ির মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আগামীতে সাধারণ মানুষের অযথা ঘোরাঘুরি আরও উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাবে। গত শুক্রবার রাজধানীর ছোট-বড় ও মাঝারি মানের প্রায় এক ডজন মার্কেট, বিপণিবিতান ও শপিংমল ঘুরে দেখা গেছে, সব জায়গাতেই ঈদ কেনাকাটায় আসা মানুষের ভিড়। তাদের প্রায় সবাই ঈদের জন্য শৌখিন কাপড়-চোপড়, প্রসাধনী কিংবা অর্নামেন্টস কিনতে এসেছেন। বিলাসীরা গাদাগাদি ভিড় ঠেলে গৃহসজ্জার বিভিন্ন জিনিস কিনছেন। শুধু মার্কেট-শপিংমলই নয়, গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর ছোটবড় ফার্নিচারের দোকানগুলোতে সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্র কিনতে আসা ক্রেতার ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। এদিকে শুধু কেনাকাটা করতেই নয়, নিত্যনতুন ফ্যাশনের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে ও দরদাম করে স্রেফ সময় কাটানোর জন্যও বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী এ মার্কেট থেকে ও মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকে নেহাত শখের বশে মার্কেটের রেস্টুরেন্টে বসে দলবেঁধে ইফতারি সারছেন। এছাড়া সামান্য জিনিস কিনতে এসে সারাদিন মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়। অন্যদিকে গত ৬ মে থেকে সিটি সার্ভিসের বাস চলাচল শুরুর পর বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাস-মিনিবাস, রিকশা-অটোরিকশা ও ভ্যানে ভেঙে ভেঙে গ্রামে ফেরা মানুষের একটি বড় অংশই পথে নেমেছেন শখের বশে। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান দফায় দফায় বন্ধ থাকায় তাদের অনেকে এরই মধ্যে কয়েক দফা গ্রাম থেকে ঘুরে এসেছেন। অথচ ঈদযাত্রায় নানা ভোগান্তি নিয়েও তারা আবারও বাড়ি যাচ্ছেন নেহাত পুরানো দিনের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে। কেউবা শুধুমাত্র একঘেয়েমি কাটাতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গ্রামে ঘুরতে যাচ্ছেন। এদিকে শুধু ঘরমুখো গণপরিবহণ কিংবা মার্কেট শপিংমলই নয়, বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্র ও দলবেঁধে আড্ডা দেওয়ার পুরনো স্পটগুলোতে গত কয়েকদিন ধরে ভিড় জমে উঠেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, হাতিরঝিল ও পূর্বাচলের তিনশ ফিট সড়কের আশপাশসহ আধা ডজন স্পট ঘুরে দেখা গেছে, সবখানেই তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষের ঢল। তাদের বেশিরভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে না কেউই। বরং তাদের কেউ কেউ দল ধরে গলাগলি ধরে মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছেন। এসব স্পটের্ যাব-পুলিশের নিয়মিত টহল থাকলেও তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন। অথচ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া, বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে হলে পুলিশের কাছ থেকে মুভমেন্ট পাস নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নথিপত্রে এখনো বলবৎ রয়েছে।