করোনাভাইরাস

সংক্রমণ-মৃতু্য নিয়ে তথ্যবিভ্রাট

প্রকাশ | ১১ জুন ২০২১, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত সারাদেশের করোনা পরিস্থিতির পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরলেও এর সঙ্গে বাস্তবতার গরমিল দেখা যাচ্ছে। এমনকি আক্রান্ত রোগীর মৃতু্য সংখ্যায়ও ভিন্ন চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র পাওয়া না গেলে বেসামাল পরিস্থিতিতে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে। এছাড়া ভুল তথ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। এতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে জনগণের উদাসীনতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত ৭ জুন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮ করোনা রোগী মারা যায়। এর মধ্যে রাজশাহীর চারজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনজন ও পাবনার একজন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে এদিন সেখানে করোনায় মৃতের সংখ্যা তিন জন দেখানো হয়। এর পরদিন অর্থাৎ ৮ জুন একই হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রাজশাহীর পাঁচজন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চারজনের মৃতু্যর কথা জানানো হয়। অথচ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী আটজনের মৃতু্যর কথা স্বীকার করে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন তিনজন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে দু'জন এবং ২২, ২৯ ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে একজন করে মারা গেছে। রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, ৮ জুন যে ৮ ব্যক্তি মারা গেছে তাদের মধ্যে চারজনের নমুনা পরীক্ষার আগেই মৃতু্য হওয়ায় তাদের করোনা রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। একই দিন নাটোরে করোনায় দু'জনের মৃতু্যর কথা স্থানীয়রা নিশ্চিত করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে একজনের কথা উলেস্নখ করা হয়েছে। নাটোরের স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনায় আক্রান্ত একজনকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তবে পথে তার মৃতু্য হয়। এ কারণেই হয়তো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে একজনের হিসাব বাদ পড়েছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারীদের ভাষ্য, সব হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য না আসায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাচ্ছে না। শুরু থেকেই বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়নি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য না পেলে ভবিষ্যতে রোগী ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনায় বিশাল সমস্যা হবে। এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডক্টর মুশতাক হোসেন বলেন, 'আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র আমরা জানি না। এটা না জানলে ভবিষ্যতে এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা সঠিক হবে না। তাই দেশে একাধারে দুই-তিন পর্যায়ের গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ করে শনাক্তের গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বের করা দরকার, যেটায় বেশ ঘাটতি আছে।' এদিকে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র নিরূপণে যে সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা দরকার তার অর্ধেক টেস্টও হচ্ছে না বলে মনে করেন কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের ভাষ্য, সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র না পাওয়ায় আক্রান্ত রোগীর অনুপাতে মৃতের সংখ্যা কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে। দেশে করোনা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া গেলে সে তুলনায় মৃতু্যর হার যে খুব বেশি নয়, তা জানা যেত বলে মত দেন তারা। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যচিত্রের সঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যার যে গরমিল রয়েছে তা ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট লোকজন জানায়, প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি, সুস্থ ও মৃতু্যর তথ্য তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাচ্ছেন; কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের পাঠানো তথ্য (হাসপাতালে ভর্তি রোগী) করোনাসংক্রান্ত রোজকার বুলেটিনে যুক্ত করছে কি না তা তারা নিশ্চিত নন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালের বাইরে আরও ২৮ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা চলছে। এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় সব সময়ই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সাধারণ বেড ও আইসিইউ কেবিনে রোগী ভর্তি থাকছে; কিন্তু এখনো ৮ হাসপাতালের নাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকার বাইরে রয়েছে। ফলে সেখানে কত সংখ্যক করোনা রোগী নিয়মিত ভর্তি হচ্ছে তার হিসাব আসছে না। ঢাকার বাইরে এ হিসাবে আরও ঘাটতি রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা নিয়েই নয়, মৃতের সংখ্যা নিয়েও প্রায়ই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা জানান, তারা সরেজমিনে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে আক্রান্ত ও মৃত রোগীর যে সংখ্যা পাচ্ছেন তা উলেস্নখ করে পত্রিকা অফিসে নিউজ পাঠাচ্ছেন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে সে সংখ্যা না থাকায় নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের সীমান্তের জেলাগুলোতে সম্প্রতি সংক্রমণ ও মৃতু্য বৃদ্ধি পাওয়ার পর এ তথ্যবিভ্রাট আরও বেশি হচ্ছে বলে জানান তারা। এদিকে সম্প্রতি সীমান্ত জেলার পাশাপাশি সারাদেশেই করোনার সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়লেও নমুনা পরীক্ষা সে হারে বাড়েনি বলে মনে করেন চিকিৎসাসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, এ কারণে শনাক্তের হারে গরমিল দেখা যাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ করোনা ভীতির বাইরে চলে এসেছে, যা আগামী পরিস্থিতির জন্য দিনে দিনে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমাদের দেশে করোনা টেস্টের হার অনেক কম। ফলে অনেক রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এছাড়া উপসর্গবিহীন অনেক রোগী রয়েছে, যারা নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না। অথচ তাদের মাধ্যমেই সংক্রমণ বেশি বাড়ছে। এসব কারণে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ করোনাভীতির বাইরে চলে আসায় স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। এছাড়া তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানানোর তেমন উদ্যোগও নেই। ফলে গোটা পরিস্থিতি জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।' অধ্যাপক ডা. সুলতানা শাহানা বানু বলেন, 'কারোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার বাইরে থেকে গেলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত কেউ করোনা সংক্রমিত হলে তার মৃতু্য ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। করোনা থেকে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।' তার মতে, আগে থেকেই নমুনা পরীক্ষা না হলে এসব রোগীর জটিলতা অনেক বেড়ে যায়। তাদের চিকিৎসাও জটিল হয়ে পড়ে। এসব রোগীকে মৃতু্যর হাত থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে একই ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, 'যে সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটা সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য যথেষ্ট না। স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিন যে বুলেটিন প্রকাশ করছে; তাতে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব না।' প্রকৃত চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষা আরও অনেক বেশি বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।