শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
২০২১ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা

ক্ষীণ হয়ে আসছে সব সম্ভাবনা

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

করোনাভাইরাসের কারণে বছর নির্ধারিত সময়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে জুন-জুলাইয়ে এসএসসি এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করা এখন অনেকটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষা নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের সশরীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এনে এসএসসিতে ৬০ দিন এবং এইচএসসিতে ৮৪ দিন ক্লাস করানোর পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে পাবলিক পরীক্ষা দুটিই বছরের একেবারে শেষভাগে নিতে হবে। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অসম্ভব।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব না হলে এসএসসি পরীক্ষা আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ২০২২ সালের এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা নিতে হবে। শিক্ষা বোর্ডগুলোকেও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষা আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কমপক্ষে এক মাস পর এইচএসসি পরীক্ষা নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আবার সময়ের মধ্যে যদি কলেজ খোলা সম্ভব না হয়, তাহলে ৮৪ কর্মদিবস সরাসরি ক্লাসে পাঠদান শেষ করে ডিসেম্বরের আগে এইচএসসি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হবে না। এতে এইচএসসি পরীক্ষা আরও পিছিয়ে যাবে। ফলে দুটি পাবলিক পরীক্ষার বিকল্প খোঁজা ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা আরও এক-দুই মাস পেছানো হলেও এবার অটোপাস দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রয়োজনে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জুলাইয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলেও আশা করেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে সময়ের মধ্যে স্কুল-কলেজ খোলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তারা দেশে করোনা সংক্রমণের প্রথ ঢেউয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ৫ জুন করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বর্তমান সময়ের মতো আড়াই হাজার ছাড়িয়ে যায়। দিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮২৮ জন। যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং জুন মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ৩০ জুন সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৮২ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়। তবে

পরবর্তী চার মাস তা ধাপে ধাপে কমতে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ২ হাজার ৬৯৫ জন; ৩১ আগস্ট ২ হাজার ১৭৪ জন; ৩০ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৪৩৬ জন এবং ৩১ অক্টোবর ১ হাজার ৩২০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। যদিও পরবর্তী মাসে ফের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আড়াই হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যায়। ৩০ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২ হাজার ৫২৫ জন রোগী শনাক্ত করে। তবে তা ফের নিম্নমুখী হয়ে ডিসেম্বর মাসে ১ হাজারের কোটায় এসে ঠেকে। ৩১ ডিসেম্বর ১ হাজার ১৪ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। আর ১৪ জানুয়ারি ৮১৩ জন রোগী শনাক্তের মধ্য দিয়ে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নেে আসে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উপরিউক্ত পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে দেশে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা আড়াই হাজারের আশপাশে রয়েছে। যাদের একটি অংশ (৬০ শতাংশ) অতি সংক্রমণ শক্তির ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। ফলে এবারের সংক্রমণের গতি আরও খানিকটা বেগবান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সৌভাগ্যক্রে তা না হলেও করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামতে আরও অন্তত ৪ থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করতে হবে। হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা ডিসেম্বরের আগে নেওয়া সম্ভব হবে না।

এছাড়া রোজার ঈদের মতো আসন্ন কোরবানির ঈদেও ঘরমুখী মানুষের ঢল ঠেকানো না গেলে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিম্নমুখী না হয়ে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, সাধারণত রোজার ঈদের চেয়ে কোরবানির ঈদে কর্মজীবী মানুষ বেশি গ্রাে ছুটে যায়। পাশাপাশি কোরবানির গরু কেনার জন্য হাটগুলোতে ব্যাপক ভিড় জে ওঠে। এতে স্বাভাবিকভাবেই করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া এতদিন করোনা সংক্রমণের উচ্চ হার ঢাকাসহ কয়েকটি বিভাগীয় শহরে গন্ডিবদ্ধ থাকলেও এবার তা সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সেখানে নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট নাজুক। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট কঠিন হবে।

\হপ্রসঙ্গে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, 'আমরা এখনো বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস করিয়েই পরীক্ষা নিতে চাই। সেজন্য সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, হয়তো কালই তা বদলাতে হচ্ছে। ফলে আমরা কবে পরীক্ষা নিতে পারব সে ব্যাপারে এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা করোনা পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছি। তবে কয়েক মাস পিছিয়ে হলেও পরীক্ষা নেওয়া হবে।'

তবে কিছুটা পিছিয়ে হলেও এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া আদৌও সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, দুটোই যেহেতু পাবলিক পরীক্ষা তাই সারাদেশে এক সঙ্গেই নিতে হবে। অথচ শুরু থেকেই শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ব্যাপারে প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

\হপ্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, করোনা মহামারির শুরু থেকেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতের পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার দিকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। যে কারণে দুর্যোগ সময়েও তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে সক্ষ হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন থেকেছে। ফলে এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

শিক্ষা গবেষক তৌহিদুল হক মনে করেন, দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এর আওতায় আনা জরুরি। পাশাপাশি স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রম্নত প্রস্তুত করতে হবে। শিক্ষা খাতকে এতটা গুরুত্বহীন হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।

দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে পরীক্ষার ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকলেও বারবার 'অটোপাস' দেওয়া ঠিক হবে না দাবি করে তৌহিদুল হক বলেন, অটোপাসের শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে ইমেজ সংকটে পড়বে। এক সময় হয়তো মানুষ করোনা মহামারির কথা ভুলে যাবে। তবে অটোপাস করা শিক্ষার্থীদের উপর নেতিবাচক দৃষ্টি রয়েই যাবে। অনেকে তাদের অযোগ্য হিসেবেই বিবেচনা করবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে