করোনার মধ্যেই এত নির্বাচন!

স্থগিতে আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের ষ কম সংক্রমিত এলাকায়ও বিস্তারের শঙ্কা

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২১, ০০:০০

ফয়সাল খান
ভারতে করোনা মহামারি ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করার জন্য দেশটির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশকে দায়ী করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সম্প্রতি ভারতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো বড় ধরনের শোডাউন ও সভা সমাবেশ করে। ফলে দেশটিতে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ বেশ কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশে সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা ও তামিলনাড়ু ও কেন্দ্রশাসিত পদুচেরি অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর পরপরই করোনা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে দেশটিতে। ফলে মৃতু্য ও সংক্রমণ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ। পার্শ্ববর্তী ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশ সীমান্তে যখন সর্বোচ্চ সতর্কতা আর জেলায় জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে ঠিক তখনই দেশজুড়ে চলছে নির্বাচনের ডামাডোল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে উচ্চ সংক্রমিত কিছু এলাকার নির্বাচন স্থগিত করলেও আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে চারটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন ও ২০৪টি ইউনিয়ন পরিষদসহ বেশ কয়েকটি পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্থানীয় নির্বাচনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এরইমধ্যে তৈরি করছে। তবে এ মহামারির মধ্যেই এসব নির্বাচন করতে অনড় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার উলেস্নখ করে শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, আবহাওয়া, পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে করোনাকালে যেকোনো ধরনের নির্বাচন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, করোনাকালীন সময়ে নির্বাচনের কারণেই ভারতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর হস্তক্ষেপ করবেন না তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি আর মহামারি এক নয়। মহামারির সময় অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়। যেহেতু জনসমাগম হলে করোনাভাইরাস বিস্তার লাভ করে, সেহেতু জনসমাগম হয়, এমন সব কাজ পরিহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে জনসমাগম হয় এমন সব কর্মসূচি পরিহার করতে বলা হয়েছে। করোনার সংক্রমণ রোধে গণপরিবহণে দুই সিটে একজন করে যাত্রী পরিবহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এমন সময় ঘটা করে দেশব্যাপী নির্বাচন আয়োজন আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা যতই স্বাস্থ্যবিধির কথা বলা হোক না কেন, নির্বাচনী প্রচারণায় স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয় না। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচন করা অনেকটাই অসম্ভব। সম্প্রতি উপনির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও ঢাকা ১৪ আসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাদাগাদি করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শোডাউন করতে দেখা গেছে। এমনকি সামনে পেছনে দাঁড়ানো নিয়ে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনাও ঘটেছে একটি দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করার আগে অবশ্যই স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ নিতে হবে। বর্তমানে সংক্রমণ কম হলেও ভোটের তারিখ আসতে আসতে সংক্রমণ বাড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় করোনা সংক্রমণের হার কতটুকু এ নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগই ভালো পরামর্শ দিতে পারবে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের একক সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। পার্শ্ববর্তী দেশের অবস্থা থেকে শিক্ষা না নিলে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব বলেন, এই সময় নির্বাচন না করাই ভালো। তবে একান্ত করতেই হলে সংক্রমণের হার বিবেচনা করতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে, যেসব এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে সেখানেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের শোডাউন, প্রচার সভা ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। গাদাগাদি করে নেতাকর্মীরা চালাচ্ছেন প্রচারণা। মাস্ক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করছেন না অনেকেই। প্রার্থীরাও ভোটারদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিলেও স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে প্রশাসনের কঠোর অবস্থান দেখা যায়নি। ডনর্বাচন কমিশন যে বরিশাল বিভাগকে নির্বাচনের উপযুক্ত স্থান বলে মনে করছে, সেখানেও প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। আমাদের বরিশাল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনিতেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হতো না। আর যখন মৃতু্য ও সংক্রমণের হার কম ঘোষণা করা হলো, তখন থেকে সেই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। প্রচারণা বা পথ সভায় মাস্ক, স্যানিটাইজার ব্যবহার করছেন না বেশিরভাগ প্রার্থী। স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা প্রায় প্রতিদিনই গাদাগাদি করে গণসংযোগ করা হচ্ছে। ডনর্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন গত ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠানের কথা ছিলো। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভোটগ্রহণের কয়েকদিন আগে ১ এপ্রিল স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। পরে তিন দফায় কমিশন সভা শেষে ২ জুন নতুন করে তারিখ ঘোষণা করে। নতুন তারিখ অনুযায়ী আগামী ২১ জুন এসব ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণের কথা ছিল। নতুন করে বৃহস্পতিবার ১৬৩টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট স্থগিত কারয় ২১ জুন ২০৪টি ইউপির ভোট হতে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রার্থী মারা যাওয়ার কারণে আগেই চারটি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট ২১ জুনের পরিবর্তে ১৪ জুলাই পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া ৯টি পৌরসভা ভোট স্থগিত করলেও ২১ জুন দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ ও ঝালকাঠি সদর পৌরসভায় ভোট হবে। এ দিন লক্ষ্ণীপুর-২ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাছাড়া আগামী ২৮ জুলাই ঢাকা-১৪, কুমিলস্না-৫ ও সিলেট ৩ আসনেও উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে আইইডিসিআর'র করোনাবিষয়ক চিঠি পর্যালোচনা, মাঠ প্রশাসন এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের থেকে মতামত নিয়ে এরইমধ্যে খুলনা বিভাগের সবগুলোসহ ১৬৩টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট স্থগিত করে নির্বচন কমিশন। তাছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং নোয়াখালী জেলার ইউপি ভোট স্থগিত করা হয়। বরিশাল বিভাগে করোনা সংক্রমণ সহনীয় থাকায় এখানকার কোনো নির্বাচন স্থগিত করেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার জানিয়েছে, যেহেতু বরিশাল বিভাগের সংক্রমণের হার সহনীয় পর্যায়ে আছে, বরিশাল বিভাগের সব নির্বাচন ২১ জুন অনুষ্ঠিত হবে। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, গত ১৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে এ বিভাগে দুইজনের মৃতু্য হয়েছে। নতুন করে ২০ জনের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল জেলার সিভল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, করোনার মধ্যে নির্বাচন হলে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ সময় নির্বাচন না করলেই ভালো হতো। তবে সরকার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই মিটিং মিছিল না করে প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া সবক্ষেত্রে শারিরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে নির্বাচন কর্মকর্তা ও প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়া এলাকা ঢাকা মহনগরীতে নতুন করে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২১২ জন, মারা গেছেন ১০ জন। সিলেটে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬ জন, মারা গেছেন ১ জন। তাছাড়া কুমিলস্নায় ২৩ জন, লক্ষ্ণীপুরে ১৪ জন ও দিনাজপুরে ৩৮ জন নতুন করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।