তবুও কেউ কথা রাখেনি

সবকিছু খোলা রেখে বিধি-নিষেধের মেয়াদ বৃদ্ধি করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে সারা বছর লকডাউন দিয়েও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

প্রকাশ | ১৪ জুন ২০২১, ০০:০০

ফয়সাল খান
মেয়াদ বৃদ্ধি করে দফায় দফায় লকডাউন বাড়ানো হলেও সবকিছু চলছে প্রায় আগের নিয়মেই। বেশিরভাগ জায়গায় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেও স্বাস্থ্যবিধি গুরুত্ব পাচ্ছে না। লকডাউনের মধ্যে শিল্পকারখানা, শপিংমল ও গণপরিবহণ চালু রাখতে সংশ্লিষ্টরা স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতসহ যেসব প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন তা রক্ষা করেননি কেউ। ফলে লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ করেও করোনা সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন দেয় সরকার। বিভিন্ন দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করার পর যা এখনো চলমান আছে। শুরুতে গণপরিবহণ, শপিংমল, শিল্পকারখানাসহ জরুরি সেবা ছাড়া প্রায় সবকিছু বন্ধের পরিকল্পনা থাকলেও তা করতে পারেনি সরকার। শর্ত সাপেক্ষে শিল্পকারখানা ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই লকডাউন দেওয়া হয়। এরপর একে একে খুলে দেওয়া হয়, শপিংমল ও গণপরিবহণ। চলছে দূরপালস্নার বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ফেরিও। তবে শর্ত অনুযায়ী কথা রাখছেন না কেউই। সবকিছু খোলা রেখে বিধি-নিষেধের মেয়াদ বৃদ্ধি করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে সারা বছর লকডাউন দিয়েও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, লকডাউন শুরু হওয়ার পর মার্কেট ও শপিংমল খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করেন দোকান মালিকরা। এতে কাজ না হলে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে বেচাকেনার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে মার্কেট খুলে দেওয়ার জোর তৎপরতা চালায় দোকান মালিক সমিতির নেতারা। সরকারও তাদের প্রস্তাব বিবেচনা করে শর্তসাপেক্ষে মার্কেট শপিংমল খুলে দেয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরই সেসব প্রতিশ্রম্নতি ভুলে যায় তারা। রমজানের ঈদের আগে ও পরের বেচাকেনায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং 'নো মাস্ক নো সার্ভিস' কার্যকর করতে পারেনি মার্কেট ও শপিংমলগুলো। এখনো স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা না করেই বেচাকেনা করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে প্রশাসনের পাশাপাশি তারাও কঠোর অবস্থানে আছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার নজিরও আছে। তাছাড়া অনেক মার্কেট কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করছে। যেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে সেসব জায়গায় তারা মনিটরিং বাড়াবেন। এদিকে, ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে অর্ধেক যাত্রী পরিবহণ, চালক-সহকারী ও যাত্রীদের বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা এবং জীবাণুনাশক দিয়ে পরিবহণ পরিষ্কার করার শর্ত দিয়ে লকডাউনের একমাস পর চালু করা হয় গণপরিবহণ। ওই সময় আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া স্মারকলিপি ও সংবাদ সম্মেলনে পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতারা স্বাস্থ্যবিধি এবং ভাড়া নৈরাজ্য রোধ করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। শুরুতে কয়েকদিন স্বাস্থ্যবিধি মানলেও এরপর সেই শর্ত বেমালুম ভুলে গেছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহণগুলো ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। আর বেশিরভাগ পরিবহণ প্রতি সিটেই যাত্রী নিচ্ছে। কোনো পরিবহণেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই। যারা এক সিট ফাঁকা রাখছেন তাদের অনেকেই আবার দাঁড় করিয়ে যাত্রী নিচ্ছেন। বেশিরভাগ যাত্রী ও পরিবহণ শ্রমিকদের মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও বাড়তি ভাড়া নিতে ভুল করছেন না কেউ। এ নিয়ে পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিদিনই যাত্রীদের বাগ্‌বিতন্ডা চলছে। রাজধানীর কুড়িল থেকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতাসহ ৩০০ ফিট সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহণে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহণ করতে দেখা গেছে। ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে বেশি। ইসমাইল নামের ওই রুটের একজন নিয়মিত যাত্রী জানান, সাধারণ সময়ে যে ভাড়া ৪০ টাকা ছিল তা এখন ৬৫ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। বিআরটিসি বাসগুলো যাত্রীর চাপ বেশি থাকলে দুই আসনসহ দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়। কিন্তু ভাড়ার কোনো কমতি নেই। যা চাইবে তাই দিতে হবে। আবার অনেকেই পরিচিতজন ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পাশাপাশি সিটে বসতে চান। তাদের একজনের সঙ্গে কথা হয় কারওয়ান বাজার এলাকায়। শামীম নামের শেকড় পরিবহণের ওই যাত্রী জানান, মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন। তাই পাশাপাশি সিটে ইচ্ছা করেই বসেছেন। কিন্তু একই সময় অন্যান্য সিটেও দু'জন করে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। সব সিট পূর্ণ থাকলেও আবার যাত্রী তোলা হচ্ছে। জানতে চাইলে চালকের সহকারী জানায়, সামনের স্টপেজে সিট খালি হবে তাই আগে থেকে যাত্রী তুলে নিয়েছি। আলাপকালে একাধিক পরিবহণ চালক জানিয়েছেন, অফিসের সময় অনেক চাপ থাকে, তখন তারা অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে না চাইলেও অনেকেই জোর করে উঠেন। গেট বন্ধ রাখলে অনেকই লাথি দিয়ে খুলে ফেলেন। তাই মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করেই বেশি যাত্রী পরিবহণ করছেন। স্যানিটাইজার বা প্রতি টিপে বাস জীবাণুমুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। প্রভাতী বনশ্রী পরিবহণের এক চালক সহকারী জানিয়েছেন, মাঝেমধ্যে আগের নিয়মেই বাস ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেন তারা। নিউ ভিশন পরিবহণের এক চালক জানান, মালিক যেভাবে বলে সেভাবেই সব করেন। মালিক চান না চাইলে শ্রমিকরা নিজের টাকায় জীবাণুনাশক স্প্রে করতে পারেন না বলেও জানান তাদের কেউ কেউ। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যায়যায়দিনকে বলেন, গণপরিবহণে যে উদ্দেশ্যে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে অর্ধেক যাত্রী বহন ও স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্ত ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ভিন্নচিত্র। অতিরিক্ত যাত্রীর পাশাপাশি দ্বিগুণ ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে। এতে যাত্রী সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। তবে দূরপালস্নার বেশিরভাগ বাসে অর্ধেক যাত্রী নিলেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৬০ শতাংশের পরিবর্তে কোথাও কোথাও নানা অযুহতে দ্বিগুণ, তিনগুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া আসন সংকটের দোহাই দিয়ে বাড়তি টাকাও নিচ্ছেন অনেকেই। বিভিন্ন লোকাল ও কমিউটার ট্রেনেও গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। বিমানে প্রতি সিটে যাত্রী নেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ইকবাল সিদ্দিকী নামের একজন বিমানে যাত্রীদের ছবি দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, করোনা শুধু বাসেই ছড়ায়, বিমানে নয়। হাট-বাজারগুলোতে মানুষের সমাগম বেড়েছে। রাজধানীর হাট-বাজারে আসা অধিকাংশ মানুষের মুখে নেই মাস্ক। মাস্ক ছাড়াই সারছেন কেনাকাটা। সরকারের নির্দেশনায় বাজারে নো মাস্ক, নো সার্ভিসের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তরাঁসমূহে মানা হচ্ছে না কোনো বিধিনিষেধ। যে যেভাবে পারছেন নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান চালু রাখছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে। কোনোটা আবার দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা হচ্ছে। অথচ খাদ্য বিক্রি ও সরবরাহ করার জন্য সকাল ৬টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। আর হোটেলের মোট আসনের অর্ধেক সংখ্যক ক্রেতা বসানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রতিটি চেয়ারেই বসছেন ক্রেতারা। প্রবেশপথে রাখা হচ্ছে না কোনো জীবাণুনাশক। ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না টেবিল, চেয়ার। খাবার সরবরাহকারীদের মুখেও নেই মাস্ক। খালি হাতে টেবিল পরিষ্কার করে, সেই হাতে তোয়ালে মুছে অন্যজনকে খাবার পরিবেশন করছে অনেকেই। এদিকে, জরুরি সেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস, প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা ৫০ শতাংশ লোকবল দিয়ে পরিচালনা করতে বলা হলেও তা মানছে না বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। গাদাগাদি করে কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে বিভিন্ন শিল্পকারখানার শ্রমিকদেরও। বাড়ি ফেরার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে তেমন জোড়ালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।