বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ইস্যু চাপা ক্ষোভ ছড়াচ্ছে বিএনপিতে

হাসান মোলস্না
  ১৬ জুন ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৬ জুন ২০২১, ০৯:২০

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ার পরেও নীরব থাকা এবং ফের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মীই ক্ষুব্ধ। এই দুই ইসু্যতে দলের সিদ্ধান্ত অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয় মাথায় রেখে নেতাকর্মীরা এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছেন না। তবে এই দু'টি ইসু্যতে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভবিষ্যতে বড় মাশুল গুনতে হতে পারে বলে সিনিয়র নেতাদের বিভিন্ন মাধ্যমে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা জানাচ্ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ২৭ এপ্রিল থেকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। এরপর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। গুরুতর অসুস্থ বোনের উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার জন্য ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ৫ মে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে একটি আবেদন করেন। অসুস্থতার জন্য মানবিক বিবেচনায় সরকার অনুমতি দেবে ভেবে পাসপোর্ট নবায়নসহ বিদেশে নেওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে তার পরিবার। কিন্তু আবেদন করার চারদিন পর পর্যালোচনা ও দাপ্তরিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে গত ৯ মে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে দেওয়ার 'সুযোগ নেই' বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। শীর্ষ নেত্রীর জীবন-মরণ প্রশ্নে এমন সিদ্ধান্ত আসার পরে ক্ষোভ ও হতাশার কথা জানিয়ে মহাসচিব প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। এই প্রেক্ষিতে দলের পক্ষ থেকে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, 'আমরা বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে আবেদন করিনি। তার পরিবার করেছে। এখানে তার পরিবারই সিদ্ধান্ত নেবে।' এ নিয়ে এতদিন দল একেবারে নীরব থাকলেও ইদানিং নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, 'যুদ্ধের সময় তরুণ প্রজন্ম যে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে নেমেছিল। এখন তেমন দেখা যায় না। গণতন্ত্রের নেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাকে বিদেশ যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরে নীরবতা দুঃখজনক।' অপর এক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নেতাকর্মীদের বলেন, 'দলের সহযোগীরা আন্দোলন সংগ্রামের কথা বলছেন। এই সংগঠনগুলো কী করেছে? আপনারা কী পরিমাণ আন্দোলন-মিছিল করেছেন? নিজ এলাকায় খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে বা তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আপনারা কী পরিমাণ আন্দোলন মিছিল করেছেন? কাউকে তো মানা করা হয়নি। উপদেশ দেওয়া বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করা হলে গণবিপস্নব হয়। তবে বিএনপি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই এগোবে।' আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপির ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এবং শরিক রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুলস্নাহ চৌধুরী বলেন, 'বিএনপির নেতৃবৃন্দকে বলব, জিয়ার জন্য ১৫ দিনের কর্মসূচি বাদ দিয়ে ওই ১৫ দিন খালেদা জিয়ার জন্য রাস্তায় থাকেন, আবার জামিনের আবেদন করেন, আদালতে ১০ হাজার লোক অবস্থান নেন। এখন খালেদা জিয়াই আপনাদের বাঁচাতে পারেন, খালেদা জিয়াই আপনাদের ক্ষমতায় নিতে পারেন, খালেদা জিয়াই তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে পারেন। আর কেউ পারবে না।' বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, শীর্ষ নেত্রীর বিষয়ে দলের গাছাড়া ভাব দেখে দলের নেতাকর্মীরা চরম ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, খালেদা জিয়াকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি না দেওয়ার পরে দলের নীরব থাকা ঠিক হয়নি। সূত্রমতে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে কর্মসূচি দেওয়ার চাপ ছিল। ঈদের দিনে মানববন্ধন, অনশনসহ শান্তিপূর্ণ বেশকিছু কর্মসূচি দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। কিন্তু তা করা হয়নি। উল্টো দলের একটি প্রভাবশালী মহল এ নিয়ে কোনো কর্মসূচি না দিতে হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেয়। এর আগে তারা স্থানীয়সহ সব ধরনের নির্বাচন বর্জনের পরামর্শ দিয়ে তা বাস্তবায়নও করে। এসব নেতার পরামর্শ সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং হাতেগোনা কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সংসদে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সূত্রমতে, এতদিন নীরব থাকলেও নেতাকর্মীদের চাপের মুখে খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার অনুমতি ও স্থায়ী মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরুর বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে বিএনপি। গত শনিবার এমন আভাসও দিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ভার্চুয়াল এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, 'দেশনেত্রীকে মুক্ত করতে হবে। তাছাড়া এখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হবে না। দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলন দিয়েই শুরু করতে হবে গণতন্ত্রের মুক্তির আন্দোলন।' সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার ইসু্য ছাড়াও নতুন করে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তেও দলের প্রচন্ড ক্ষোভ আছে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মনে করে একের এক নির্বাচনের ফল বিপক্ষে গেলেও নির্বাচনে থেকেই আন্দোলনের পথে হাঁটতে হবে। গত ফেব্রম্নয়ারিতে ইউপি এবং গত মে মাসে শূন্য হওয়া সংসদের ৪ উপনির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি। নির্বাচনে না যাওয়ার প্রসঙ্গে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ায় এবং এই নির্বাচন কমিশনের অযোগ্যতা ও প্রতিটি নির্বাচনে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে আপাতত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।' এদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে থাকা দলের মধ্যসারির একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে একের এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই বিএনপিকে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতে, ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের প্রায় সব নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। সেগুলোর অধিকাংশ ফলও বিএনপির পক্ষে ছিল। সে সময় রাজপথের আন্দোলনেও বিএনপির ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। ওই নেতারা বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় সরকার পতন করে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে এমন ধারণা ছিল সবার। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচন বর্জন সব আশা সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছে। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে যদি কারচুপির কারণে সরকার গঠন সম্ভব নাও হতো আন্দোলন যেমন জোরদার হতো তেমনি সংগঠনও শক্তিশালী থাকত। এখন না করা যাচ্ছে আন্দোলন আর সংগঠনেরও বেহাল দশা। এ অবস্থায় সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার জন্য নেতাকর্মীরা সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে