নতুন আতঙ্ক :টিকা সনদ জটিলতা

প্রকাশ | ২৯ জুলাই ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২১, ০৯:৪০

সাখাওয়াত হোসেন

অবসরপ্রাপ্ত কলেজ অধ্যক্ষ মুহম্মদ ওবাইদ উলস্নাহ গত ১১ ফেব্রম্নয়ারি রাজধানীর পুলিশ লাইন হাসপাতাল থেকে করোনার প্রথম ডোজ টিকা নেন। আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৩ এপ্রিল। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে তিনি টিকার সনদ সংগ্রহ করতে যতবারই সুরক্ষা অ্যাপসে ঢুকেছেন ততবারই প্রতিউত্তর মিলে 'আপনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা গ্রহণ সম্পন্ন হয়নি'। এ অবস্থায় হতাশ হয়ে মাস দেড়েক তিনি আর সনদ সংগ্রহের চেষ্টা করেননি। তবে গত সোমবার সকালে একবারের চেষ্টাতেই তিনি টিকার সনদ পেয়ে যান। কিন্তু এটির প্রিন্ট কপি হাতে নিয়ে তার 'চক্ষু চরকগাছ'। সনদটিতে প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা থাকলেও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার কোনো তথ্যই নেই। শুধু ওবাইদ উলস্নাহ একাই নন, দুই ডোজ টিকা নিয়েও সঠিক সনদ মেলেনি হাজার হাজার মানুষের। এদের মধ্যে দেশে বেড়াতে এসে টিকা নেওয়া প্রবাসীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। ডবল ডোজ টিকা নেওয়ার পরও সনদ না পাওয়া তারা প্রবাসের কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। অথচ তাদের অনেকের কাজে যোগ দেওয়ার সময় দ্রম্নত ফুরিয়ে আসছে। কারও কারও আকামার মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। সনদ না নিয়ে প্রবাসে গেলে নিজ খরচে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে মোটা অংকের অর্থ গচ্ছা দিতে হবে। করোনাকালীন সংকটে হাতে সে পরিমাণ নগদ অর্থ না থাকায় অনেকে বিদেশ যাত্রা স্থগিত রেখেছেন। অন্যদিকে এক ডোজ টিকা না নিয়েই দুই ডোজ টিকা নেওয়ার সনদ পাওয়ার ঘটনাতেও বিপাকে পড়েছেন অনেকে। তারা টিকাদান কেন্দ্রসহ বিভিন্ন দপ্তরে ধর্না দিয়েও এ ভুল সংশোধন করাতে পারছেন না। তাদের টিকা নেওয়ার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় এদের মধ্যে অনেকে টিকা নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও কেউ কেউ হাল ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ তাদের মধ্যে বয়স্ক মানুষ রয়েছে, যাদের দ্রম্নত টিকা নেওয়া জরুরি। করোনাভাইরাসের টিকার কোনো ডোজ না নিয়েই টিকা গ্রহণের সনদ পাওয়া এবং দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও সঠিক সনদ না পাওয়া- এ দু'টি বিষয় নিয়েই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইসিটি মন্ত্রণালয় এবং হাসপাতালের কর্মকর্তারা একে অন্যের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। এ ব্যাপারে যে যার মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তবে সংকট সমাধানের চেষ্টা বরাবরের মতো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। আইটি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ইনফরমেশনাল গ্যাপ কিংবা প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে কিছু ভুল হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সংকট মূলত সমন্বয়ের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় থাকলে এ ধরনের ছোট-খাটো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। গত ২৪ জুলাই কোনো টিকা না নিয়েই জীবন সূত্রধর (৪৪) নামের এক ব্যক্তির সনদ পাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের চান্দপুর গ্রামের এই বাসিন্দা জানান, তিনি আগামীতে টিকা নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. শামসউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, 'এটা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। সংশোধনের কোনও সুযোগ থাকলে তা করে দেওয়া হবে।' তবে এ ব্যাপারে তিনি কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারেননি। এর আগে ২০ এপ্রিল একজন গণমাধ্যমকর্মী কোনো টিকা না নিয়েই রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতাল থেকে দুই ডোজ টিকা গ্রহণ সম্পন্ন করার সনদ পান। এ ঘটনার পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার পরেও সনদ না পাওয়ার বিপুলসংখ্যক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে টিকা নেওয়া একজন মইনুল ইসলাম। তিনি জানান, তিনি ও তার স্ত্রী ১৫ ফেব্রম্নয়ারি প্রথম ডোজ এবং ১৫ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেন। তার স্ত্রী অনলাইনে টিকা গ্রহণের সনদ পেলেও তিনি পাননি। সুরক্ষা অ্যাপে ঢুকলে তাকে বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় ডোজ এখনও সম্পন্ন হয়নি। এ ধরনের ঘটনার কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। টিকা না নিয়েই সনদ পাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, 'এটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো ভুল নয়। টিকার সনদে যে কেন্দ্রের নাম এসেছে সেই কেন্দ্র থেকে ভুল তথ্য দেওয়া হতে পারে।' তবে টিকাদান কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের কোনো ভুল নেই। একজন মানুষ টিকা না নিলে কীভাবে তার ডেটাবেজ সফটওয়্যার আপ হবে। অন্যদিকে, মইনুল ইসলামের সনদ পাওয়া নিয়ে জটিলতার বিষয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আইটি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইসিটি বিভাগের ঝামেলার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সুরক্ষা অ্যাপে কারিগরি জটিলতার বিষয়টি এমআইএস পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'সফটওয়্যারে যে কোনো মুহূর্তে কারিগরি জটিলতা হতে পারে। এটা তো আমাদের হাতে নেই। যেখানে সমস্যা দেখা দিয়েছে, সেখানে তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করেছি।' তবে টিকা না নিয়েও সনদ পাওয়ার দায় আইসিটি কর্তৃপক্ষ নিতে চায়নি। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের দাবি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোই আইসিটি বিভাগ সংরক্ষণ ও ব্যবহার করে থাকে। তাই এ ধরনের ভুলের ক্ষেত্রে কী হয়েছে সেটি তথ্য প্রদানকারী কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, ভ্যাকসিন শুধু করোনা প্রতিরোধকই নয়, এটি এখন ক্ষেত্রবিশেষে জীবিকা রক্ষার কবজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী কর্মজীবী, শিক্ষার্থী কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গমনকারীদের জন্য টিকা সনদ এখন অপরিহার্য। যা আগামীতে আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়বে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে এ সুবিধা নেওয়ার জন্য করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণকারীরা এর সনদ দেখিয়ে ভ্যাকসিন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট থাকলে পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকিটের সঙ্গে আর কোনো কাগজ দেখাতে হবে না। কোয়ারেন্টিনেও থাকতে হবে না। ভ্যাকসিন পাসপোর্টই সব কাগজের সহায়ক হবে। এছাড়া এই ভ্যাকসিন পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসে প্রবেশ, বিনোদনকেন্দ্রে ভ্রমণ ইত্যাদিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে। এমনকি বিভিন্ন চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রেও এই পাসপোর্ট ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখে এরই মধ্যে বাংলাদেশে আইসিটি বিভাগের প্রোগ্রামাররাও কাজ শুরু করেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভ্যাকসিন দেওয়ার পর যে কার্ড দেওয়া হচ্ছে ওই কার্ডে কিউআর কোড আছে। প্রোগ্রামাররা এখন ডাটাবেজ তৈরি করবে। ডাটাবেজ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট দিয়ে যাতে ভেরিফাই করা যায়, সে ব্যবস্থা থাকবে। দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকা সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে। এটা না পেলে ভ্যাকসিন পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না। টিকা সার্টিফিকেটের অর্থ হলো দুই ডোজ টিকা নেওয়া হয়েছে। এটার হার্ডকপি প্রিন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। মোবাইলে কিউআর (কুইক রেসপন্স) কোড থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, 'টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট অটোমেটিক জেনারেট হবে এবং আমরা একটা ভ্যাকসিন পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য এরই মধ্যে আমাদের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি।' করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ এ প্রসঙ্গে যায়যায়দিনকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা গণটিকাদান কর্মসূচির লক্ষ্য অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশগামী যাত্রীরা চরম বিড়ম্বনায় পড়বে। দেশে অবস্থানরত প্রবাসী কর্মীদের কর্মসংস্থানে নানা সংকট সৃষ্টি হবে। তাই এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। যাতে আগামীতে আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এ ছাড়া টিকা না দিয়েই যাদের দুই ডোজ টিকা সম্পন্ন হওয়ার সনদ দেওয়া হয়েছে এবং ডবল ডোজ টিকা নেওয়ার পর যাদের সনদে এক ডোজ টিকা দেওয়ার তথ্য উলেস্নখ করা আছে- এসব ভুলত্রম্নটি দ্রম্নত সংশোধন করতে হবে। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিগত ত্রম্নটির কারণে এসব ঘটনা ঘটতে পারে উলেস্নখ করে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের জরুরি ভিত্তিতে সমন্বয় করা উচিত।