আশা জাগাচ্ছে গণটিকার গতি

প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২১, ০০:০৮

সাখাওয়াত হোসেন

দেশে গণটিকাদান কর্মসূচিতে নতুন করে গতি ফিরতে শুরু করেছে। এতে দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃতু্যর ভয়াবহ বিপর্যয় কেটে যাওয়ার আশা জেগেছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে জনগণকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। জোরদার করতে হবে নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। তা না হলে টিকাদান কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, গণটিকাদানের নতুন গতি আশা জাগাচ্ছে সত্য, তবে এ কর্মসূচি আরও অনেক বেশি পরিকল্পিত হতে হবে। টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তৈরি করতে হবে। টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে বয়স্কদের টিকার আওতায় আনতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিসহ অন্যদের কাজে লাগানো এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। টিকা গ্রহণে মৃতু্যঝুঁকি কমায়- এমন বার্তা সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। বয়স্কদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া সঠিক সংরক্ষণ, পরিবহণ ও টিকাদান ব্যবস্থার মাধ্যমে টিকার মান অক্ষুণ্ন রাখাও জরুরি। কোনো ধরনের গাফিলতি বা দায়িত্ব অবহেলায় মূল্যবান এ টিকার একটিও যেন নষ্ট না হয় সে টার্গেট নিয়ে এগোতে হবে। সার্বিক বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে পরিকল্পিত ছক তৈরির পরামর্শ দেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৯ জুলাই পর্যন্তত্ম দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন ও দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬ জন। অর্থাৎ কোভিশিল্ডের মোট ১ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার ১১৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। সিনোফার্মের প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ১৮ লাখ ৫৪ হাজার ৭০১ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন ২৩ হাজার ৯৫৩ জন। দুটি মিলিয়ে সিনোফার্মের মোট ১৮ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫৪ ডোজ টিকা ব্যবহৃত হয়েছে। এদিন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে ফাইজারের ৫০ হাজার ৫২৩ এবং মডার্নার ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৩ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ চারটি কোম্পানির মোট ১ কোটি ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৭৪৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, দেশে ৭ ফেব্রম্নয়ারি টিকাদান শুরু হয়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ১৮ হাজার ৪শ' জনকে প্রথম ডোজ টিকা এবং ২৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৬৬ জনকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়। এরপর টিকা সংকটের কারণে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার কার্যক্রম অত্যন্ত ধীর গতিতে চলতে থাকে এবং ১৯ মে পর্যন্ত এসে পুরোপুরি থমকে যায়। তবে দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কর্মসূচি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। ২৫ এপ্রিল থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৮৭ দিন সময় লাগে মাত্র ১৯ লাখ ৭২ হাজার টিকা দিতে। অর্থাৎ এ সময় গড়ে ২৩ হাজারেরও কম টিকা দেওয়া হয়েছে। তবে এ দফায় জোরেশোরে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর প্রতিদিনই দুই থেকে আড়াই লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। ২৯ জুলাই দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩ জন সিনোফার্ম ও ৬৩ হাজার ৭৩৮ জন মডার্নার টিকা নিয়েছেন। এর আগের দিন ২৮ জুলাই ১ লাখ ৮১ হাজার ৪৮৬ জন সিনোফার্মের এবং ৫৯ হাজার ৭৬৫ জন মডার্নার টিকা নেন। অর্থাৎ দুই দিনে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৯৯২ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আশা এ গতি আগস্টের শুরু থেকে আরও বাড়বে। এদিকে টিকার নিবন্ধনেও আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। ২৯ জুলাই বেলা আড়াইটা পর্যন্ত এক কোটি ৩৯ লাখ ৪০ হাজার ৯০ জন টিকা নেয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ১২২ জন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে এবং ২ লাখ ৫৪ হাজার ৯৬৮ জন পাসপোর্ট ব্যবহার করে নিবন্ধন করেছেন। দেশের করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অগ্রাধিকার তালিকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীসহ সব জরুরি সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শুধু অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, তাদের টিকা প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দেশে করোনায় কোন বয়সের মানুষের মৃতু্য বেশি সেই জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান চিত্র তুলে ধরে তারা জানান, গত ২৭ জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট ২০ হাজার ১৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। এরমধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুর সংখ্যা ৫৭ জন (০.২৮ শতাংশ)। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সি ১২৯ জন (০.৬৪ শতাংশ), ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সি ৪৩৩ জন (২.১৬ শতাংশ), ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সি ১ হাজার ১৬৫ জন (৫.৮২ শতাংশ), ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সি ২ হাজার ৪০৯ জন (১২.০৪ শতাংশ), ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সি ৪ হাজার ৭৭১ জন (২৩.৮৪ শতাংশ), ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সি ৬ হাজার ২৩০ জন (৩১.১৩ শতাংশ), ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সি ৩ হাজার ৪৮৪ জন (১৭.৪১ শতাংশ) এবং ৮১ থেকে ৯০ বছর বয়সি ১ হাজার ৯৬ জন (৫.৪৮ শতাংশ)। এ হিসাবে ৪১ থেকে ৮০ বছর বয়সি মানুষের মৃতু্য ১৪ হাজার ৪৮৫ জন। যা মোট মৃতু্যর ৭২.৩৮ শতাংশ। এ উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় ষাটোর্ধ্ব কিংবা পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ (২ কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ জন), তাদেরই প্রথমে টিকাদানে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। চলমান মৃতু্যহার কমাতে এর কোনো বিকল্প নেই। অথচ সরকার কোভিড-১৯ টিকার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর করতে যাচ্ছে। এরইমধ্যে টিকাপ্রাপ্তির বয়সসীমা ২৫ এ নামিয়ে আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) থেকে তাদের নিবন্ধন করা হচ্ছে। এছাড়া ৭ আগস্ট থেকে দেশের ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা গ্রহণ করা যাবে বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। এ সময় প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিদিন ৬০০ জনকে টিকা দেওয়া হবে। সে হিসাবে দেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে প্রতিদিন ২৭ লাখ ৪২ হাজার ৬০০ জন হবে। অর্থাৎ সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে ছয় দিনে ১ কোটি ৬৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬০০ ডোজ টিকা লাগবে। এর বাইরে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডেও টিকা দেওয়া হবে। অথচ দেশে ৩০ জুলাই পর্যন্ত মোট ২ কোটি ৩৯ লাখ ৬২০ ডোজ টিকা এসেছে। এরমধ্যে ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছে ১ কোটি ২ লাখ, ফাইজারের টিকা ১ লাখ ৬২০, মডার্নার ৫৫ লাখ ও চীনের সিনোফার্মের ৮১ লাখ। ২৯ জুলাই পর্যন্ত ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এ হিসাবে মজুত আছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৪১ ডোজ টিকা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত স্বল্প মজুত নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গণটিকাদান কর্মসূচির যে বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। তবে চীন, রাশিয়া ও কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যে সংখ্যক টিকা পাওয়ার আশ্বাস পাওয়া গেছে, তাতে সে সংকট কেটে যাবে। এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও টিকাদান কর্মসূচি আরও গতিশীল হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, জুলাই মাসেই দেশে সোয়া কোটির বেশি টিকা এসেছে। আগস্ট মাস থেকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের কেনা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়মিতভাবে দেওয়ার আভাস দিয়েছে। পরবর্তীতে আগামী বছরের শুরুর মধ্যেই ধাপে ধাপে সরকারের হাতে বিপুল সংখ্যক টিকা চলে আসবে। আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবকসহ যারা ফ্রন্ট লাইনার তাদেরকে প্রথমে টিকা দিতে হবে। এরপর যাদের সবচেয়ে বয়স বেশি এবং দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য রোগে ভুগছে তাদেরকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি জানান, অগ্রাধিকারের তালিকা ঠিক করাই আছে। এখন এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। কম বয়সিদের টিকার নিবন্ধন করা হলেও অগ্রাধিকার তালিকার গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানান এই জনস্বাস্থ্যবিদ।