যত কষ্ট শ্রমিকের

কেউ কথা রাখেনি

হুমকির মুখে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ফের সংক্রমণ বাড়বে

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২১, ১১:০৭

হাসান আরিফ
শিল্পকারখানা খোলার ঘোষণায় রোববার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে ফেরি করে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে ঢাকামুখী মানুষ -ফোকাস বাংলা

সরকারি সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারছেন না নীতিনির্ধারকরা। আর কথা দিয়ে কথা রাখছেন না শিল্পকারখানার মালিকরা। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে কোনোভাবেই শিল্পকারখানা চালু করার সুযোগ দেওয়া হবে না বলে সরকারের একাধিক মন্ত্রী-সচিব নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে নিজেদের অবস্থানে স্থির থাকতে পারেননি তারা। আর ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ না রাখার কথা বললেও সে কথা রাখেননি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোরতম বিধিনিষেধের (লকডাউন) মধ্যেই শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মো. রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা খুলে দিয়েছে সরকার। ফলে রোববার ভোর ৬টা থেকে বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত থেকে রপ্তানিমুখী সব শিল্পকারখানা চলছে। এই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী চলমান বিধিনিষেধের ২৩ দফা নির্দেশনার বাকি ২২ দফা বহাল রয়েছে দেশে। শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সরকারি ঘোষণার পরপরই কঠোরতম লকডাউন উপেক্ষা করে বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া, মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এবং ঢাকার আমিনবাজার দিয়ে কর্মজীবী যাত্রীর ঢল শুরু হয়। সব ধরনের গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, মাইক্রোবাস, মোটরবাইক, সিএনজি, রিকশা আর ভ্যানে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া আর চরম বিড়ম্বনা সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ঢাকায় ফেরেন শ্রমিকরা। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে শ্রমিকদের চরম ভোগান্তি নিয়ে ঢাকায় আসার বিষয়টি সরকারের নজরে আসায় বিধিনিষেধের শিথিলতা আনে। এর অংশ হিসেবে শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত বাস লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে লঞ্চ চলাচল সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। একজন পোশাক শ্রমিকের নূ্যনতম বেতন আট হাজার টাকা। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় মাস শেষে বেতনের নিশ্চয়তা দিয়েছিল মালিকপক্ষ। শর্ত ছিল ৬ আগস্ট থেকে কাজে যোগ দিতে হবে। হঠাৎ ১ আগস্ট থেকে কারখানা চালু হওয়ায় তাদের বাধ্যতামূলক কাজে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। নয়তো চাকরি চলে যাওয়ার পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোর বেতনও অনিশ্চিত হয়ে যাবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ঈদ উৎসব করতে যাওয়া গ্রামবন্দি লাখো মানুষ কর্মস্থলে যোগ দিতে একসঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করছে। শিল্পকারখানা চালু করার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সরকার ও মালিকপক্ষের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়, কারখানা চালানো হবে ঢাকায় অবস্থানরত আশপাশের শ্রমিক দিয়ে। কোনো অবস্থাতেই ঢাকার বাইরের শ্রমিক আনা হবে না। তবে ৫ আগস্টের পরে পর্যায়ক্রমে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। এ সময়ের আগে যারা কাজে যোগ দিতে পারবেন না, তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হবে। চাকরি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, শিল্পকারখানার মালিকরা সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠান চালু করার অনুমোদন পেয়েই শ্রমিকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা তাদের অধীনস্তদের মাধ্যমে কারখানা চালুর দিন সব শ্রমিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলেন। এরপর শ্রমিকদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো শুরু করেন তারা। গুরুত্বপূর্ণদের জানানো হয়েছে ফোন করে। তারা জানিয়েছেন তাদের অধীনস্তদের। এভাবে দু'তিন ঘণ্টার মধ্যে সব শ্রমিকের মধ্যে খবর পৌঁছে যায় রোববার কাজে যোগ দিতে হবে, নয়তো চাকরি থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে চাকরি বাঁচাতে তাঁরা সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছাতে বাধ্য হয়ে ঢাকার পথে ছুটতে শুরু করেন। তাদের গন্তব্য টঙ্গী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানা অধু্যষিত এলাকা। পোশাক শ্রমিকদের বক্তব্য, সরকার তো অর্ডার দিয়াই খালাস। তাদের মতো ক্ষুদ্র শ্রমিকদের আসতে পথে দুর্ভোগের কথা একটুও ভাবেনি। চার-পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে আসতে হয়েছে তাদের। হাঁটতে হয়েছে মাইলের পর মাইল। তার ওপর পথে খাবার হোটেল খোলা ছিল না। সব কিছু মিলিয়ে তাদের খুবই করুণ অবস্থা হয়েছে। তারপরও তাদের আসতে হয়েছে জীবিকার তাগিদে। একাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে শ্রমিক সর্বনিম্ন ৮ হাজার টাকা বেতন পায় তার যদি ঢাকায় পৌঁছতে ৪ হাজার টাকাও খরচ হয় তারপরও লাভ আছে। তাদের বক্তব্য, ৪ হাজার টাকা খরচ করে এসে বেতন পেলে আরও ৪ হাজার টাকা হাতে থাকবে। আর কাজে যোগ না দিলে কোনো টাকাই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত না। এর সঙ্গে চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই সব দিক বিবেচনা করে অর্থ খরচ করে ভোগান্তি আর কষ্ট সঙ্গী করে তারা এসেছেন কর্মস্থলে। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, পোশাক কারখানাসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে চাকরি যাবে না। বেতনও ঠিক থাকবে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিষয়টি বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। যারা ঢাকায় অবস্থান করছেন, বিশেষ করে যারা ঈদে বাড়ি যাননি এবং যারা ২২ জুলাইয়ের মধ্যে ফিরে এসেছেন তাদের নিয়েই মালিকরা কারখানা পরিচালনা করবেন। ঢাকার বাইরে থেকে তারা কোনো কর্মীকে নিয়ে আসবেন না। যারা এই পাঁচ দিন কাজ করবেন না, যারা বাইরে আছেন-তাদের চাকরিতে কোনো সমস্যা হবে না। তারা ৫ তারিখের পর ধাপে ধাপে আসবেন। একই কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেবিনেট সচিব। এই বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা রোববার থেকে ঢাকায় অবস্থানকারী শ্রমিক দিয়েই কারখানা চালু করেছি। যারা এসেছে তারা নিজ উদ্যোগেই এসেছে। শনিবারের পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার প্রথমেই ভুল করেছে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে। আমরা সরকারকে বারবার বলেছিলাম কারখানা বন্ধ না করার জন্য। এখন শ্রমিকরা করোনাভাইরাসের হট স্পটে রয়েছে। সেখান থেকে তারা আবার ঢাকায় এলো। এসে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু রপ্তানি অব্যাহত রাখতে হলে কারখানা চালু রাখতেই হবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, সরকারের নীতিনির্ধারকরা তাদের অবস্থানে স্থির থাকতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই তাদের। ফলে চলমান বিধিনিষেধে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনছে না। আবার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার দেশে কয়েক দফা বিধিনিষেধ হলেও এর ফলে কতটা সুফল পাওয়া গেছে সে বিষয়ে কোনো জরিপও করা হয়নি। তবে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শ্রমিকদের ঢাকা আসার বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রম আইনে কোথাও বলা নেই বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজে যোগ দিতে না পারলে বেতন কাটা যাবে বা চাকরি থাকবে না। তারপরও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন। যা সরকারেরই ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। এখানেও সরকার অবস্থান ধরে রাখতে না পারায় বিধিনিষেধের সুফল পাওয়া যাবে না। ফলে স্বাস্থ্যবিদদের কথা অনুযায়ী সংক্রমণ আরও বাড়বে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সরকারকে বলা হয়েছে, মানুষের ঢল যেভাবে ঢাকায় প্রবেশ করেছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই ছিল না। এতে করোনাভাইরাস ধারণাতীতভাবে সংক্রমিত হবে। দেশের হাসপাতালগুলোতে চলমান আইসিইউ বেড সংকটের মধ্যেই সাধারণ বেডও খালি পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত সংক্রমণ সামাল দেওয়ার স্বক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। স্বাস্থ্যবিদদের সঙ্গে একমত পোষণ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, চলমান বিধিনিষেধের মধ্যে গার্মেন্ট খুলে দেওয়ায় ফের সংক্রমণ বাড়বে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে।