ভারতের সঙ্গে এ মাসেই ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি

চুক্তির ফলে ভারতের পণ্য পরিবহনে ৭০ শতাংশ খরচ কমবে সেভেন সিস্টারে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের একটি খাত হতে পারে

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আহমেদ তোফায়েল
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূবার্ঞ্চলে পণ্য পেঁৗছানোর জন্য দুই দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে এ মাসেই। এর আগে ট্রান্সশিপমেন্ট (পণ্য স্থানান্তর করার স্থান) চুক্তির খসড়া অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদ। ভারত এই চুক্তির ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ কম খরচে তাদের মূল ভূ-খÐ থেকে উত্তর-পূবার্ঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পেঁৗছাতে পারবে। তবে বাংলাদেশ কতটা সুবিধা পাবে সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে ভারতের উত্তর-পূবার্ঞ্চলীয় রাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির ফলে এই রাজ্যগুলোয় ভারতীয় পণ্যের সহজ প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। যার কারণে বাংলাদেশি পণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ট্রানজিট পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত চুক্তিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে স্থান ও অন্য সুবিধাদি থাকা সাপেক্ষে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে অগ্রাধিকার পাবে। এ মাসের শেষ দিকে ভারতে দুই দেশের সচিব পযাের্য়র বৈঠকে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোটর্ ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ চুক্তি সই হওয়ার কথা। চুক্তিটি পঁাচ বছরের জন্য স্বাক্ষরিত হবে। পঁাচ বছর পর এটি স্বয়ক্রিয়ভাবে আরও পঁাচ বছরের জন্য কাযর্কর হবে। তবে কোনো দেশ চাইলে ছয় মাসের নোটিশে চুক্তিটি বাতিল করতে পারবে। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসাসর্ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নিবার্হী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য ভালো ব্যবসায়িক সুযোগ তৈরি করবে। এটি দেশের অতিরিক্ত রাজস্ব আয়ের একটি খাত হতে পারে। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যদি ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ পারবে না কেন। এই ধরনের সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) উপদেষ্টা আন্তজাির্ত বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং এ ধরনের সুবিধা যখন কোনো দেশকে দেয়া হবে সেখান থেকে আমরা কী সুবিধা পাব সেটাই প্রধান বিবেচ্য। ভারতের উত্তর-পূবার্ঞ্চলে বাংলাদেশে প্রচুর পণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে। দিন দিন সেখানে চাহিদাও বাড়ছে। তবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের পণ্য যখন সেভেন সিস্টারে যাবে তখন বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা কমবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের উৎপাদনমুখী খাতে। এছাড়া এই সুবিধা দেয়ার ফলে দুই বন্দর এবং মহাসড়কে পণ্যবাহী যানের জট বাড়বে। যা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অরুণাচল, আসাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরাÑ এ সাত রাজ্য ভারতের সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত। এসব রাজ্যের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কাযর্ক্রম হয়ে থাকে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত চুক্তিতে পণ্য পরিবহনের জন্য চারটি রুটের কথা বলা হয়েছেÑ চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে আগরতলা; চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর থেকে তামাবিল হয়ে ডাউকি; চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর থেকে বিবিরবাজার হয়ে সীমান্তপুর এবং চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর থেকে শিওয়ালা হয়ে সুতারকান্দি। মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী বন্দর থেকে ভারতে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের ট্রাক ও জাহাজ ব্যবহার করতে হবে। আরও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে। এর মধ্যে রয়েছে, দুই দেশের উপকূলীয় নৌ-পরিবহনকে শক্তিশালী করা, কোনো ক্রু মারা গেলে সংশ্লিষ্ট দেশে তার মৃতদেহ পেঁৗছানো এবং স্থল বন্দরের সক্ষমতা ও সুবিধা বাড়ানো। জানা গেছে, ভারত তার পশ্চিম ও পূবর্ অংশের মধ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে নৌকরিডর চালু করতে আগ্রহী। এই বিষয়টিও বৈঠকে আলোচনা হবে। বতর্মানে নৌ-প্রোটকলের অধীনে বাংলাদেশ তিনটি রুট অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো হলোÑ কলকাতা থেকে সুন্দরবন এবং গোয়ালন্দ হয়ে আসাম, করিমগঞ্জ থেকে সুন্দরবন এবং আশুগঞ্জ হয়ে বহরামপুর এবং বহরামপুর থেকে রাজশাহী হয়ে আসাম। কিন্তু শেষ রুটটি নিয়মিত ব্যবহার হচ্ছে না। ভারত এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়া পদ্মা এবং যমুনা নদীর নাব্যতা বাড়াতে ভারতের অথার্য়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ এ মাসেই শুরু হবে। আলোচনার পর একই ইস্যুর কারণে আত্রাই নদীর ভারতীয় অংশে ড্রেজিং শুরু হবে। আত্রাই নদী নওগঁা জেলার মধ্য দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বেশ কয়েকটি ভারতীয় জেলা হয়ে ফের দিনাজপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নৌ-পরিবহণ সচিব পযাের্য় প্রতি বছর বৈঠক হওয়া কথা রয়েছে। তবে এবার দুই বছর পর বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। সবের্শষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। সূত্র বলছে, দুটি বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট পণ্য পরিবহন চুক্তি বাস্তবায়নের সুবিধাথের্ই স্ট্যান্ডাডর্ অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) হচ্ছে। এরই মধ্যে খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। মতামত দিতে জাতীয় রাজস্ব বোডর্সহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্টদের কাছে খসড়া পাঠানো হয়েছে। গত মাসে ‘অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোটর্ ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। দুই দেশের মধ্যে চলমান সৌহাদর্্যপূণর্ সম্পকর্ সুদৃঢ় করাই এর উদ্দেশ্য। খসড়া এসওপিতে দেখা গেছে, নিদির্ষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে পণ্য বাংলাদেশ দিয়ে ভারতে ঢুকবে। পণ্য বাংলাদেশ হয়ে ভারতে ঢোকার সময় ৩০ দিন ঠিক করা হয়েছে। খসড়া এসওপির ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রয়োজনে সময় বৃদ্ধির আবেদন করতে পারবে অপারেটর। যৌক্তিক কারণে বাংলাদেশ কাস্টমস তা অনুমোদন করবে। পণ্য পরিবহনের পদ্ধতি সম্পকের্ অনুচ্ছেদ-২-এ বলা হয়েছে, ট্রানজিট পণ্যবাহী কনটেইনার বাংলাদেশে ঢোকার আগে ভারতের কাস্টমস তা সিল লক করবে। কাস্টমস-সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে ওই সিল নম্বর উল্লেখ থাকবে। বাংলাদেশের কাস্টমস পরীক্ষা করে পণ্য ঢুকতে ও বের হওয়ার অনুমোদন দেবে। তবে যৌক্তিক কারণে কনটেইনার পরীক্ষা করতে পারবে বাংলাদেশ কাস্টমস। লক ভাঙা পাওয়া গেলে পণ্য পরীক্ষা করতে পারবে। একইভাবে কনটেইনারবিহীন পণ্য পরিবহনেও দুই দেশের পরীক্ষার সুযোগ থাকবে। এদিকে খসড়া চুক্তিতে ১৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এতে দুই বন্দরে সুযোগ ও সুবিধা থাকলে পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ট্রানজিট পণ্যকে অবহেলা করা যাবে না। বন্দর ব্যবহারের জন্য বিদ্যমান হারে চাজর্ পরিশোধ করবে ভারত। কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না।