শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসার অধিকার আদায়ে আদালত নির্ভরতা বাড়ছে

জাহিদ হাসান
  ০৩ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০৩ আগস্ট ২০২১, ০৯:৪৬

দেশে করোনা মহামারির মধ্যে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা অধিকার আদায়ে উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গত ২৮ দিনের ব্যবধানে দেশে এ রকম ৪টি ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এসডিজি গোল অর্জনে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা থেকে স্বাস্থ্যবিভাগ অনেক পিছিয়ে আছে। করোনাকালে বিষয়টা বেশি সামনে আসায় এই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। ফলে অধিকার আদায়ে আদালত নির্ভরতা দেখা দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের স্বল্পমূল্যে অক্সিজেন দিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃক উদ্ভাবিত অক্সিজেট নামক যন্ত্র উৎপাদনের অনুমোদন পেতে এক আইনজীবী গত ৫ জুলাই উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপর স্থানীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা উৎপাদনে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গত ২৬ জুলাই স্বাস্থ্যবিভাগ সংশ্লিষ্ট বরাবর আরেকটি উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। একইভাবে ৩১ জুলাই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের করোনা টিকাপ্রাপ্তি এবং সর্বশেষ ১ আগস্ট করোনা আক্রান্তদের জন্য হাসপাতালে শয্যা বাড়াতে রিট আবেদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, এর আগে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ হাসপাতাল, বিমান বন্দর, স্থলবন্দর রেল ও বাসস্টেশনের মতো জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় এক নারী আইনজীবী উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছিলেন। এছাড়া দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর রোগীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সঠিক রোগ নির্ণয়ে ১৫ দিনের মধ্যে সব সরকারি হাসপাতালে অকেজো যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য গত ২৭ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন ও শাম্মী আকতার লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে বিবাদী করা হয়। তারও আগে হৃদরোগের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের হার্টের রিং, বাল্ব প্রতিস্থাপন, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর মূল্য নির্ধারণে উচ্চ আদালতকে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। সর্বশেষ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে সুপ্রিম কোর্টের চার আইনজীবীর পক্ষে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশের জবাব না পেয়ে গত ৩১ জুলাই হাইকোর্টে এক রিট আবেদন করা হয়। এ প্রেক্ষিতে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের করোনা টিকা দেওয়ার বিষয়ে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা যায়যায়দিনকে বলেছেন, করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে প্রধানমন্ত্রী সব জেলা সদর হাসপাতালে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে আইসিইউ ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়ার এক বছর পার হলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এসব কারণে চিকিৎসা খাতের বিভিন্ন বিষয়ের সুরাহার জন্য উচ্চ আদালতে রিটনির্ভরতা বাড়ছে। এ ধারাবাহিকতায় দেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য শয্যা বাড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে ১ আগস্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ রিট করা হয়। রিটে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। এরও আগে ২৬ জুলাই দেশীয় ওষুধ কোম্পানি গেস্নাব বায়োটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। টিকা ট্রায়ালের ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স সিদ্ধান্ত নিতে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে রেজিস্ট্রি ডাক ও সংশ্লিষ্টদের ই-মেইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান ওই নোটিশ পাঠান। নোটিশে স্বাস্থ্যসচিব ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) পরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়। পাশাপাশি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের আগে বঙ্গভ্যাক্স টিকা বানর বা শিম্পাঞ্জির শরীরে প্রয়োগ করে তা পরীক্ষা করার শর্ত দিয়ে গেস্নাব বায়োটেককে দেওয়া বিএমআরসি'র চিঠি প্রত্যাহারেরও দাবি জানানো হয়। তারও আগে করোনাভাইরাস মহামারিকালে প্রায় ১০ মাস কাজ করে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একদল গবেষক স্বল্পমূল্যে করোনা রোগীদের হাই-ফ্লো অক্সিজেনের চাহিদা পূরণে অক্সিজেট নামক স্বল্পমূল্যের সি-প্যাপ ভেন্টিলেটর উদ্ভাবন করেন। এই যন্ত্র কোনো বিদু্যৎশক্তি ছাড়াই অক্সিজেন সিলিন্ডার বা হাসপাতালে অক্সিজেন লাইনের সঙ্গে যুক্ত করে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অক্সিজেট নামের সি-প্যাপ ভেন্টিলেটরটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পরও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) অনুমোদন না দেওয়ায় গত ৫ জুলাই বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পর সীমিত আকারে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায়। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এছাড়া এসডিজি গোল অর্জনে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উলেস্নখ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ বাস্তবে তা থেকে পিছিয়ে আছে। সিভিল সোসাইটির মধ্যে থেকে কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। করোনাকালে এই বিষয়টা বেশি করে সামনে আসছে। মূলত অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার ঘাটতিতে এমনটা হচ্ছে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় ঔষাধাগার, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তর, পিডাবিস্নউডি, রাজনৈতিক নেতারা জড়িত আছেন। এই অব্যবস্থাপনা থেকে বের না হলে টেকসই উন্নয়ন হবে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল যায়যায়দিনকে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা নিয়ে ইদানীং যেভাবে রিট হচ্ছে তাতে এই বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে। কিন্তু তাতেও সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না। এর কারণ, হাইকোর্ট থেকেও সব রিটের রুলিং হচ্ছে না, এজন্য দুই পক্ষের একটি সমন্বয় দরকার। সার্বিকভাবে কি উপায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে সে ব্যাপারে সরকারের সব দপ্তরের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে