ঝুঁকি নিয়েও ঝামেলায়

করোনা উপসর্গ নিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন শত শত শ্রমিক ষ ছোট শিল্পকারখানায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে না ষ অসুস্থতা গোপন করে কাজে যোগ দিয়েছেন ষ ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২১, ১০:০০

সাখাওয়াত হোসেন

রোববার সকাল পৌনে ৮টার দিকে মালিবাগের শিকদার গার্মেন্ট কারখানার প্রধান ফটকে গেটকিপারদের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে তর্ক করছেন আলেয়া খাতুন। তার দাবি, যশোরের মণিরামপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে ট্রাকে চড়ে পথে ১০/১২ ঘণ্টা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঢাকায় এসেছেন। এ কারণে রাত থেকে গায়ের তাপ কিছুটা বেশি। তবে সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই। অথচ গেটে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপার পর গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ তাকে কারখানায় ঢুকতে দিচ্ছে না। করোনা টেস্ট করে রিপোর্ট নিয়ে তাকে গার্মেন্টে আসতে বলেছে। আলেয়ার আশঙ্কা, নমুনা পরীক্ষা করিয়ে রিপোর্ট পেতে ৬/৭ দিন সময় লাগবে, ততদিনে তার চাকরি থাকবে না। আর চাকরি থাকলেও এক সপ্তাহের বেতন কাটা গেলে তার অভাবের সংসারে বড় ধরনের টান পড়বে। তাই লকডাউন উঠে যাওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকার কথা জানা থাকলেও শত ভোগান্তি ঠেলে তিনি ঢাকায় এসেছেন। শুধু আলেয়া খাতুনই নন, তার মতো বিভিন্ন শিল্পকারখানার বিপুল সংখ্যক শ্রমিক জীবিকা বাঁচাতে অসুস্থ শরীর নিয়ে রোববার কর্মস্থলে হাজির হন। এদের মধ্যে কেউ কেউ রোদ-বৃষ্টির ভ্যাপসা গরমে লঞ্চ-বাস-ফেরিতে গাদাগাদি করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া অনেকে আগে থেকেই জ্বর-সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গে ভুগছিলেন। আবার কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত পরিবারের অন্য সদস্যের সংস্পর্শে থেকে অসুস্থ। তবে তা গুরুতর না হওয়ায় এখনো নমুনা পরীক্ষা করাননি। টঙ্গী ও গাজীপুরের একাধিক গার্মেন্ট কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার, সুপারভাইজার ও গেটকিপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার প্রথম কর্মদিবসেই তারা বিপুল সংখ্যক অসুস্থ শ্রমিক পেয়েছেন। তাদের তারা কারখানায় ঢুকতে দেননি। এ ব্যাপারে তারাও কোনো আপত্তি তোলেননি। তবে কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ না দিলেও তাদের যাতে চাকরিচু্যত করা না হয়- এ অনুরোধ জানিয়েছেন। মালিবাগের এবি ফ্যাশনের সুইং অপারেটর শিউলি আক্তার জানান, ঈদের ছুটিতে কুষ্টিয়ার মিরপুরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার চারদিন পর থেকেই তিনি জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। তাদের পরিবারের আরও অনেকে একই সমস্যায় ভুগলেও তারা কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে গেছেন। তাই তিনি করোনা টেস্ট না করিয়েই অপেক্ষা করছিলেন। তবে শুক্রবার রাতে আকস্মিক গার্মেন্ট খোলার খবর পেয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে চড়ে ঢাকায় এসেছেন। এতে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে কর্মস্থলে হাজির না হলে, চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে গার্মেন্টে এসেছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পর তাকে বিনা বেতনে সাত দিনের ছুটি দিয়েছে। কাজে যোগ দেওয়ার আগে করোনা টেস্ট করে রিপোর্ট আনতে হবে বলে জানিয়েছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে রোববার ঢাকায় ফেরা গার্মেন্টকর্মী সিরাজুল জানান, তার গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরেই দু-একজন জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। স্থানীয়ভাবে সুযোগ না থাকায় তারা টেস্ট করাচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে তিনি নিজেও জ্বরে পড়েছেন। শুধু চাকরি বাঁচাতে অসুস্থ শরীর নিয়েই কর্মস্থলে এসেছেন। তবে দেরিতে কারখানায় পৌঁছায় কাজে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি। সিরাজুলের দাবি, ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসা তাদের গ্রামের অনেক শ্রমিকই জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। তাদের প্রায় সবাই কর্মস্থলের উদ্দেশে গ্রাম ছেড়েছেন। শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় তারা অনেকে কাজে যোগ দিতে পারেননি। কিছু ছোট শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের ভেতরে ঢোকানোর আগে সবাইকে সেভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। বড় গার্মেন্টগুলোতে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ কড়াকড়ি ছিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, জীবিকা বাঁচাতে এ শ্রেণির মানুষ জীবনবাজি রেখে কর্মক্ষেত্রে ছুটছে- এটাই স্বাভাবিক। আর সাধারণ সময় যারা স্বাস্থ্যবিধি ততটা মেনে চলে না, তারা এ সময় সেদিকে মোটেই ভ্রূক্ষেপ করবে না, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা আকস্মিক খোলার ঘোষণা দেওয়ার আগে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। লকডাউন তুলে নেওয়ার আগে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার প্রয়োজন হলে তা অনায়াসেই পরিকল্পিতভাবে করা যেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি, সরকার এ ব্যাপারে আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে শিল্প মালিকদের দিয়ে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গ্রাম থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের শহরে আনতে পারত। অথবা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিতে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে শুধু শিল্প শ্রমিক-কর্মচারী পরিবহণের ব্যবস্থা করা যেত। সরকার এসব কোনো ঝামেলায় যেতে না চাইলে শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলার আগে অন্তত ৩/৪ দিন সময় দিলেই পারত। এ সময়টুকুতে গণপরিবহণ চালু রেখে পথে পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মস্থলের আইডি কার্ড যাচাই করে কর্মস্থলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া যেত। এদিকে গ্রামে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের এই দুঃসময়ে সেখান থেকে আসা লাখ লাখ শ্রমিককে কোনো ধরনের পরীক্ষা না করে শুধু শরীরের তাপমাত্রা মেপে কলকারখানা সচল করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের ভাষ্য, সারাদেশেই উপসর্গহীন বিপুল সংখ্যক করোনা রোগী রয়েছে। এছাড়া জ্বর ছাড়া অন্য উপসর্গগুলো গোপন করাও সহজ। তাই শিল্পকারখানা চালু করার আগে শ্রমিক-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবারই নমুনা পরীক্ষা করা উচিত ছিল।র্ যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে যেহেতু খরচ কম এবং দ্রম্নত ফল পাওয়া যায়, সে জন্য নূ্যনতম এটাও করা যেত। এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ যায়যায়দিনকে বলেন, 'ঈদের আগে-পরে লকডাউন শিথিল করার কারণে সংক্রমণ বাড়বে- এমনটা আগে থেকেই আশঙ্কা ছিল। এর মধ্যে আকস্মিক শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ায় লাখ লাখ শ্রমিক যেভাবে গাদাগাদি করে বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকামুখী হয়েছে, তাতে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ রূপ নেবে। আগে গ্রামে সংক্রমণ কম থাকলেও এখন শহর-গ্রাম সব স্থানে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় ঈদের ছুটিতে যেসব শ্রমিক গ্রামে গেছেন তাদের একটি অংশ করোনায় আক্রান্ত হয়ে শহরে এসে বহু মানুষকে সংক্রমিত করবে। বিভিন্ন শিল্পকারখানায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে শ্রমিক-কর্মচারীদের ভেতরে ঢোকানো হলেও তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট নয়- দাবি করে এম এ আজিজ আরও বলেন, শুধু থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপলেই সংক্রমিতদের চিহ্নিত করা যাবে- এমনটা আশা করা যায় না। এটা বাস্তবসম্মতও নয়। \হ