দীর্ঘ হচ্ছে অজ্ঞাত লাশের মিছিল

ময়নাতদন্তের ফাঁদে আটকে আছে ৩২৫৪ মামলা অতিরিক্ত চাপের কারণে কখনো ভুল প্রতিবেদন ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল বাড়ানোর তাগিদ

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

ম সাখাওয়াত হোসেন
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার লতুরদী এলাকায় পাউবোর সেচ খালের কচুরিপানার নিচ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে হত্যা করে লাশ গুম করতেই সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। গত ৩ আগস্ট কুমিলস্নার গোমতী নদীর বাঁধ সংলগ্ন ইন্দ্রবতী এলাকার বিল থেকে হাত-পা বাঁধা ও গলা কাটা অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে বুড়িচং থানা পুলিশ। ১৫ আগস্ট কলাগাছিয়া নৌ-ফাঁড়ি পুলিশ নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার চর-ধলেশ্বরী এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান অবস্থায় আরেক অজ্ঞাত যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে। এ ছাড়া গত ১৮ মে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার মেন্দীপুর ইউনিয়নের ভাবনীকোনা হাওড় থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির গলা কাটা লাশ এবং ১১ জুন সাভারের ভাকুর্তায় পৃথক দুটি ক্ষেত থেকে উদ্ধার হওয়া দুই অজ্ঞাত যুবকের গলা কাটা মরদেহের পরিচয় মেলেনি। থানা পুলিশ জানায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকায় অজ্ঞাত নারী-পুরুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। গোয়েন্দারা জানান, জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চাঁদাবাজির অর্থ ভাগাভাগি এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও মাদক ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা ধরনের শত্রম্নতার জেরে খুনিরা প্রতিপক্ষকে গোপনে অন্যত্র হত্যা করে দূরের নদী-নালা, খাল-বিল-হাওড় ও গহীন বন-জঙ্গলে লাশ ফেলে রেখে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা এসব লাশ শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ লাশ গলিত বা অর্ধগলিত থাকায় অনেক সময় নিকটাত্মীয়রাও তা শনাক্ত করতে পারছেন না। তাই নির্দিষ্ট সময় পর এসব বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে শুধু হত্যাকান্ডই নয়, সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি চাপা ও বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের অপমৃতু্যর ঘটনাতেও অনেক সময় লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে হচ্ছে। দ্রম্নত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পাওয়ায় পুলিশ কখনো কখনো হত্যাকান্ডের ঘটনা অপমৃতু্য মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করছে। দীর্ঘদিন পর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পুলিশের সে ভুল ভাঙলেও খুনিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই গোয়েন্দারা এ ধরনের বেওয়ারিশ লাশের দ্রম্নত ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন। পুলিশের এক পরিসংখ্যান চিত্রে দেখা গেছে, শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই চলতি বছরের জানুয়ারিতে ময়নাতদন্তের জন্য ১৩১টি মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রম্নয়ারিতে ১১০টি, মার্চে ১১৮টি, এপ্রিলে ১১০টি, মে মাসে ১১০টি, জুনে ১১৭টি এবং জুলাইয়ে ১১৫টি মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। এ হিসাবে মাত্র ৭ মাসে মোট ৮১১টি লাশ বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৩২৯ জন অজ্ঞাত মহিলা ও ১১১ জন অজ্ঞাত পুরুষের লাশ রয়েছে। একই পরিসংখ্যান চিত্রের অপর এক ছকে উলেস্নখ করা হয়েছে, এক মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও ৩ হাজার ২৫৪টি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ৭২টি মরদেহের ভিসেরা রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেখানে এক মাসের অধিক সময় পর্যন্ত আটকে থাকা ময়নাতদন্ত বিষয়ে উলেস্নখ করা হয়েছে। তবে গত কয়েক মাসে বেশ কিছু তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী মামলার তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ওপর মামলার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ কারণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মামলার তদন্তে একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ। ময়নাতদন্তের বিলম্বের বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেবিকা রায় বলেন, লোকবল সংকট ও লাশের চাপ বেশি থাকার কারণে প্রতিবেদন দিতে সময়ক্ষেপণ হয়। এতে অনেক সময় নির্ভুল ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয় না। আবার এটিকে পুঁজি করে অনেক অনৈতিকতারও সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ডক্টর জিয়া রহমান বলেন, সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। এ কারণে আরও কিছু সরকারি হাসপাতালকে ময়নাতদন্ত করার সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান হাসপাতালগুলোকেও পর্যাপ্ত লোকবল এবং লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। এতে ময়নাতদন্ত জট অনেক কমে আসবে। অনৈতিকতার সুযোগও কমবে। বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অজ্ঞাত বেশির ভাগ পুরুষ ও নারী দুর্বৃত্তদের হাতে অপহরণের পর খুন হয়েছেন। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুমিলস্না-সিলেট মহাসড়কের সদর উপজেলার সুলতানপুর এলাকা থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় অজ্ঞাত পরিচয় এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিশ্বরোড খাঁটিহাতা হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজালাল আলম জানান, স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা ওই নারীর লাশ উদ্ধারের পর আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের কাছে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। কিন্তু কেউই নিহত ওই নারীকে শনাক্ত করতে পারেনি। ওসির ধারণা, খুনিরা ওই নারীকে অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ সেখানে ফেলে রেখেছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকার কেউ খুন হলে স্থানীয়রা তাকে চিনত। থানা পুলিশ সূত্র জানায়, শুধু হত্যাকান্ডই নয়, সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অপঘাতে মৃতু্যর পর পুলিশ এসব লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তের কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত লাশ মর্গের হিমাগারে রাখে। এ সময়ের মধ্যে কোনো স্বজন যদি মর্গে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে লাশ শনাক্ত করতে পারেন, তখন পুলিশের সহযোগিতায় লাশ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শনাক্ত না হলে নির্দিষ্ট সময় পর সেসব লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বিভিন্ন সরকারি কবরস্থানে দাফন করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি মর্গের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও যখন স্বজনদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না, তখন এসব লাশ আঞ্জুমানকে দিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। লাশ নিয়ে যদি আদালতের কোনো নির্দেশনা থাকে, কেবল সেসব লাশই সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মর্গের হিমাগারে রেখে দেওয়া হয়। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্র জানায়, অজ্ঞাত নারী-পুরুষের এসব লাশের নাম-পরিচয় আঞ্জুমানের কাছে নেই। বিভিন্ন হাসপাতাল মর্গ ও থানা পুলিশের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি এসব লাশ গ্রহণ করে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কেবল দাফন করে। পচা ও গলিত লাশগুলো গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্টরা আঞ্জুমানের হাতে কেবল পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টটি তুলে দেন। এদিকে খুন, সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা অন্য অপঘাতে মৃতু্যর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত অজ্ঞাত লাশের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের্ যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' দুই যুবক নিহত হন। তাদের বয়স আনুমানিক ৩০ ও ৩৮ বছর।র্ যাবের দাবি, নিহতরা ডাকাত দলের সদস্য। তবে তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। ১৯ জুলাই ভোররাতে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার ভারইল গ্রামের্ যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধের' পর সকালে দুই অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। তারা ডাকাত দলের সদস্য এবং ডাকাতির প্রস্তুতিকালের্ যাবের সঙ্গে তাদের 'বন্দুকযুদ্ধ' হয় বলের্ যাব দাবি করে।