শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

'নতুন শিক্ষাক্রম ইতিবাচক'

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেরিতে হলেও এটিই সুখবর। তবে শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ না থাকাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত
আমানুর রহমান
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:১৫

২০২৩ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমকে ইতিবাচক বলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটু দেরিতে হলে শুরু যে হতে যাচ্ছে, এটিই সুখবর এবং ইতিবাচক। এটিকে কীভাবে কার্যকর-বাস্তবায়ন করা যায় তার জন্য শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মতামত ও সুপারিশ নিয়ে তা বাস্তবায়নের মত দিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এ ধরনের মতামত পাওয়া গেছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংবাদ সম্মেলন করে নতুন যে শিক্ষাক্রম উপস্থাপন করেন, এর খসড়া তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেন এবং প্রধানমন্ত্রী এতে তার সম্মতিও জানান। নতুন শিক্ষাক্রম দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তবে এটি ২০২৫ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের প্রস্তুতি কতটুকু বিদ্যমান কাঠামোতে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, ইতিবাচক এতটুকু যে, সরকার শিক্ষাবিদদের দীর্ঘদিনের সুপারিশ কার্যকর করতে উদ্যোগী হয়েছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকরা। তারা কতটুকু প্রস্তুত এবং তাদের প্রশিক্ষিত করা হবে কি না, তা না হলে সৃজনশীল পদ্ধতির মতো এটিও মুখ থুবড়ে পড়বে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং বিদ্যমান অবকাঠামোতে এটি সম্ভব হবে কি না তাও বিবেচনায় নিতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২৩ সাল থেকে পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা তুলে দিয়ে শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন করা হবে। তবে ওই দুই শ্রেণিতে পরীক্ষা হবে বছরান্তে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষায় বসতে হবে না। দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো কোনো বিভাগ থাকছে না। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হবে। অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। একাদশে গিয়ে বিভাগ নির্বাচন ও পছন্দ করবে শিক্ষার্থীরা। নতুন এ শিক্ষাক্রমের মূল কারিগর হবেন শিক্ষকরা। তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলাকালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে মূল্যায়ন করবেন। আর প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে যে মূল্যায়ন হয় সেটাকে সামষ্টিক মূল্যায়ন বলা হয়। যা অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ও সহজ। কিন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য অধিক যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন। এ জন্য বিদ্যমান শিক্ষকরা কতটুকু প্রস্তুত? এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'বিদ্যমান শিক্ষকদের গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমকে বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে শিক্ষার্থীদেরও। এর জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ সবার আগে। সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের সময় যে প্রশিক্ষণ হয়েছে তা থেকে আরও অগ্রসর প্রশিক্ষণের ম্যানুয়াল তৈরি করে, দ্রম্নত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিলম্ব করার সুযোগ নেই। এমনিতে কিছুটা বিলম্ব হয়ে গেছে। বিশ্বের পাঠ্যক্রম বলা যায় প্রতিনিয়তই পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন হচ্ছে। আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। তবে শুরু যে হয়েছে এটাই ভালো ও ইতিবাচক দিক। এখন সমালোচনা বা খুঁত আবিষ্কার না করে, সামনের দিকে আগামী প্রজন্মকে ও শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে সবাইকে কাজ করতে হবে।' শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছর পরীক্ষামূলক নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর সঙ্গে সারাদেশে শিক্ষক গাইড প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হবে। এরপর ২০২৩ সালে গিয়ে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে নিয়মিত প্রশিক্ষণে এ বিষয়ও যুক্ত হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষকের সব ধরনের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিষয়টি যুক্ত করা হবে। শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর সলিমুলস্নাহ খান বলেন, 'নবম শ্রেণি থেকে যে বিভাগকেন্দ্রিক বিভাজন উঠে যাচ্ছে, সেটা ইতিবাচক দিক। তবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে কেন থাকবে? এখান থেকেও উঠিয়ে দেওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বে গ্র্যাজুয়েশনের আগে কোনো বিভাজন নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়া প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, এটা শিশুদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। একজন শিক্ষার্থী ম্যাচিউর হওয়ার আগে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা যে থাকছে না, এটা একটা ইতিবাচক সংবাদ।' ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মাঈনুল ইসলাম বলেন, 'শিক্ষাক্রম নির্দিষ্ট সময় পর যুগের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করা হয়। দেশে দেশে শিক্ষাক্রমের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক বিষয়ের সুবিধা-অসুবিধা দুটি দিকই থাকে। আমি নতুন এই শিক্ষাক্রমকে সাধুবাদ জানাই। উন্নত দেশগুলোতে বহু আগেই এ ধরনের শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আমাদের দেশেও এটা দরকার বলে মনে করি। তবে এ ধরনের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেধাবী শিকক্ষের প্রয়োজন। যেটা আমাদের দেশে ঘাটতি রয়েছে। এ সংকটের সমাধান করতে পারলে, এ শিক্ষাক্রম বর্তমান শিক্ষাক্রমের চেয়ে ফলপ্রসূ হবে।' সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা প্রভাব পড়তে পারে- এমন প্রশ্নে রাজধানীর ডেমরা এলাকার শামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর মাহবুবুর রহমান বলেন, ক্লাসে কেউ ফার্স্ট আর কেউ লাস্ট হলে এটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা দূর হবে। নতুন সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে, এক্ষেত্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সরকারকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।' পিইসি পরীক্ষা না রাখাকে ভালো দিক বলেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিত শিক্ষক মো. ইমরান নাজির। তিনি বলেন, পিইসি পরীক্ষা না রাখা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে জেএসসি পরীক্ষাটা থাকলে ভালো হতো। তাহলে এসএসসি পরীক্ষার ভীতি শিক্ষার্থীদের অনেকাংশে কমে যাবে। পিইসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে রাজধানীর খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাজিদুল ইসলাম। তার বড় ভাই মোস্তাকিম ফারুকী পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগে। তার মতে, 'প্রতিযোগিতামূলক বিষয়গুলো সব সময়ই ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করে। কারণ এখানে সুযোগ থাকে নিজেকে বেস্ট প্রমাণ করার। এতে করে তারা পড়াশোনায় আরও বেশি মনোযোগী হবে, নিজেকে যাচাইয়ের জন্য তাদের নতুন নতুন শেখার আগ্রহটা বেড়ে যাবে। তাই পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা হওয়া জরুরি।' তিনি আরও বলেন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভাগ না থাকাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কেননা এতে সব শিক্ষার্থী সব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে এবং তাদের মধ্যে কোনো হীনম্মন্যতা থাকবে না। এসএসসির পর তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কে কোন বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করবে। মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নূরজাহান। মা শাকিলা আক্তার মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না- এটা শুনে তিনি বলেন, পরীক্ষা রাখা প্রয়োজন। কেননা শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার জন্য একটা প্রতিযোগিতার দরকার আছে। শুনেছি নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে। তবে এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। কী আছে তাতে? তার মতে, যে কোনো পরিবর্তন সব সময়ই ভালো ও ইতিবাচক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে দেশে সরকারি, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৮টি। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৬৬ জন। অন্যদিকে ২০ হাজার ৬০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৫ জন। শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলেন, এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে কত দিনে, কীভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ফলে শঙ্কা থেকেই যায়, নতুন শিক্ষাক্রম কতটুকু সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং শিক্ষার্থীরা এতে উপকৃত হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে