বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
করোনাভাইরাস

শুভবার্তার মধ্যেও নতুন আশঙ্কার উঁকিঝুঁকি

দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সব মানুষ টিকার আওতায় না আসা, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি পর্যায়ে থাকা বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের নতুন ঢেউ ও মৃতু্য বৃদ্ধির কারণে, তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
জাহিদ হাসান
  ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:১৩

দেশে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে গত দেড় বছরে বিভিন্ন সময় ধরে চলা বিধিনিষেধ অনেক আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া গত দেড় মাস ধরে ক্রমেই ভাইরাসটিতে রোগী শনাক্ত ও মৃতু্যর সংখ্যা কমছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শেষ পর্যন্ত বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনাকাল দেখা দেওয়ার পর থেকে কখনোই সাধারণ মানুষকে পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মানানো যায়নি। এরমধ্যে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সময়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি ওঠানামা করলেও অনেক আগেই কলকারখানা, বিপণি বিতানসহ সব ধরনের অফিস ও প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক করা হলেও বর্তমানে তার একভাগও কেউ মানছেন না। ফলে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের বার্তা রেখে দ্বিতীয় ঢেউ কাটতে শুরু করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও সব মানুষ টিকার আওতায় না আসা, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি পর্যায়ে থাকা, বিভিন্ন দেশে সংক্রমণের নতুন ঢেউ, মৃতু্য বৃদ্ধি, তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনার কথা বলছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি উধাও হয়ে যাওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াকেও কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করলেও কোনোভাবই আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে মার্চ থেকে। তখন বিশেষত সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরে। পরবর্তী কয়েক মাসে এটি দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে। যা দেশজুড়ে শঙ্কা ও চিকিৎসা সংকট তৈরি করে। তবে টানা পাঁচ মাস পর কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে মৃতু্য ও শনাক্ত হার কমছে। গত জুলাই মাসে দ্বিতীয় ঢেউ তার চূড়া স্পর্শ করে। তখন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। যা এখন পাঁচ শতাংশের (৫ দশমিক ৯৮) ঘরে নেমে এসেছে। এছাড়া লকডাউনের মধ্যে প্রতিদিন আড়াইশ'র বেশি মানুষের মৃতু্য হয়েছে। উপসর্গে মারা গেছেন অনেকে। আমরা যদি সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারি তা হলেই সংক্রমণের বর্তমান হার ধরে রাখা সম্ভব। রোগতত্ত্ববিদরাও দেশে করোনা শনাক্তের হার ও মৃতু্য কমে আসাকে ভালো লক্ষণ বলে মনে করছেন। পাশাপাশি অন্য একটি ঝুঁকির (তৃতীয় ঢেউ) কথাও বলছেন। জানতে চাইলে একাধিক ভাইরোলোজিস্ট যায়যায়দিনকে বলেন, ভাইরাসটির রূপান্তরের বিষয়ে এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন ধরন দেখা দেওয়ার আশঙ্কা সব সময় আছে। অতি সম্পতি ডেল্টার ধরন বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ বিস্তারের ও মৃতু্যর প্রধান কারণ ছিল। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্তের খবর জানানো হয়। আর চলতি বছরের মার্চে এসে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেয়। গত জুন থেকে ভারতে উৎপত্তি করোনার ডেল্টা ধরন ছড়িয়ে পড়লে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। জুলাই মাসে এসে সংক্রমণ ও মৃতু্য ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আক্রান্তের সংখ্যার হিসাবে দেখা যায়, গত ৬ জুলাই দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১০ হাজার ছাড়ায়। এরপর ১২ আগস্ট পর্যন্ত ৩৮ দিনের মধ্যে ৩০ দিনই শনাক্ত রোগীর হার ১০ হাজারের বেশি ছিল। এরমধ্যে ২৮ জুলাই একদিন সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্তের রেকর্ড হয়। অন্যদিকে জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ওঠে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এর মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে আগস্টের প্রথম দিক থেকে রোগী শনাক্তের হারে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়। এখনো সে প্রবণতা অব্যাহত আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মানদন্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহের বেশি ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। দেশে প্রায় দেড় মাস ধরে সংক্রমণের ক্রম নিম্নমুখী প্রবণতায় বলা যায়, পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণের পথে। কিন্তু এখন তেমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। স্বাস্থ্যবিধিও যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবখানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি যে কোনো সময় খারাপ হতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশে কি অন্য দেশেগুলোর মতো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তৃতীয় ঢেউ আসার শঙ্কা রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানার আশঙ্কা কিছুটা কম। তবে এরই মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ও দেশের বিমানবন্দরগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। দেশে এখন রোগী শনাক্তের যে হার, তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে, এটা বলা যাবে না। টানা তিন সপ্তাহ যদি পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যায়। সে ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন নূ্যনতম ২০ হাজার লোকের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে এবং দেশের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে এখন নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে গড়ে ২০ হাজারের মতো, যা এক মাস আগেও ছিল ৫০ হাজারে বেশি। এক মাসের ব্যবধানে নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা কমেছে ৩০ হাজারের অধিক। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ এলে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে আসার কথা। এখনো শনাক্তের হার ৬ শতাংশের ঘরে। যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, তাহলে অবশ্যই আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভব হব। তবে আশঙ্কার বিষয়টা অন্য জায়গায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের এখনো দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আমরা মনে করছি, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসবে। নিয়ন্ত্রণে আসার চার থেকে ছয় সপ্তাহ পরে আবার কিন্তু নতুন ঢেউ আসার আশঙ্কা থাকে।' তিনি আরও বলেন, '৮ থেকে ১২ সপ্তাহ পরে যদি আবার সংক্রমণ বাড়ে তখন এটিকে আমরা আবার তৃতীয় ঢেউ বলব। ভারতেও আসার শঙ্কা রয়েছে। এটা বাংলাদেশেও আসতে পারে, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে একেবারে উদাসীন হয়ে যাই, তাহলে কিন্তু আবার দেশে তৃতীয় ঢেউ দেখা দেবে। এ কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণে আবার অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।' সরকারের রোগত্তত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট ভাইরালোজস্টি ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, 'যদি করোনা শনাক্ত হার ৫ শতাংশের নিচে টানা দুই সপ্তহ থাকে, তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়। এছাড়া টানা চার সপ্তাহ সংক্রমণ শূন্যের কোটায় থাকলে করোনা মুক্ত ধরা হয়। যেহেতু শনাক্তের হার কমে যাচ্ছে, সেহেতু দ্বিতীয় ঢেউ কেটে যাচ্ছে বলা যায়। তবে দেশে এখনো আক্রান্ত ও মৃতু্য সংখ্যা উলেস্নখ্যযোগ্যভাবে কমছে না। এরই মধ্যে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমি নিজেও মনে করি দেশে তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে।' তিনি বলেন, সম্প্রতি বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে চীন, ভিয়েতনাম. থাইল্যান্ড, ভুটান, কোরিয়া ছাড়াও রাশিয়া, পোল্যান্ডসহ ইউরেপোরে দেশগুলোতে নতুন করে সংক্রমণের ঢেউ দেখা যাচ্ছে। সেখানে সংক্রমণে মৃতু্য বাড়তে শুরু করেছে। এমনটা যে বাংলাদেশে হবে না তা বল যাবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে করোনা সতর্কতা বিষয়টি শুরু থেকে প্রশ্নবিদ্ধ, এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে; ফলে তৃতীয় ঢেউ আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে