উদ্বেগে মধ্যবিত্ত

ঋণের বোঝা কমাতেই এবার মুনাফায় টান!

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৮

আহমেদ তোফায়েল

সঞ্চয়পত্রকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য একটা উত্তম উপায় বলা হলেও এখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। মূলত সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরের পর বিপুল পরিমাণ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। কেউ আবার অলস টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনে সরকারের ঋণ বাড়ান বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে মধ্যবিত্তদের একটি অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে উৎসাহী। বিশেষ করে ব্যাংক সঞ্চয়ে সুদের হার কমে আসায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন অনেক মধ্যবিত্ত। ফলে কিছুদিন থেকে সঞ্চয়পত্রের চাহিদাও বেড়েছিল; কিন্তু মঙ্গলবার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার পুনর্বিন্যাস করার পর মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মঙ্গলবার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কাটছাঁট করা হয়েছে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে লাভ কমবে সবচেয়ে বেশি। তবে যারা নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনবেন, শুধু তাদের জন্য পরিবর্তিত হার কার্যকর হবে। এছাড়া আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনর্বিনিয়োগ করলে তখন নতুন মুনাফার হার কার্যকর হবে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় বিনিয়োগেই নতুন হার প্রযোজ্য হবে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র প্রস্তুত না করে আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে মধ্যবিত্তরা বিপাকে পড়বেন। সাধারণ মানুষের নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র বলতে শুধু সঞ্চয়পত্র। ব্যাংকে আমানত রাখলে ৫ শতাংশের নিচে মুনাফা। ফলে এত কম লাভে ব্যাংকে টাকা রাখায় আগ্রহী নন সাধারণ মানুষ। পুঁজিবাজারে কোনো স্থিতিশীলতা নেই। পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে চরম ঝুঁকি। তাই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের বিনিয়োগের পছন্দের জায়গা সঞ্চয়পত্র। অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, প্রবাসী বা সাধারণ মানুষ তাদের শেষ সম্বল এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে ওই মুনাফা দিয়ে সংসার চালান। সরকারে এ সিদ্ধান্ত কেমন হলো জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ যায়যায়দিনকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে নিম্ন আয়, বেতনভোগী ও বয়স্ক নাগরিকরা বিনিয়োগ করেন। এ ধরনের নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনায় এ খাতের সুদহার না কমালেই ভালো হতো। তবে যে পর্যায়ে ১ থেকে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার কমানো হয়েছে তারও যৌক্তিকতা আছে। আগামীতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার আর না কমানোর সুপারিশ করেন তিনি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন যায়যায়দিনকে বলেন, সঞ্চয়পত্র দেশের মানুষের নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র। কম ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ এ খাতে বিনিয়োগ করেন। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদহার অপরিবর্তিত রাখা ইতিবাচক। তবে ১৫ লাখের বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমায় কিছু মানুষ চাপে পড়বেন। আবার সুদহার বেশি থাকায় এ খাত থেকে যত ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা সরকার করে, তার চেয়ে বিক্রি হয় অনেক বেশি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা বড় হয়, ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে যায়। এমনকি অর্থ বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে বড় বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ভোগ ও সরকারের ঋণের বোঝা কমানো এবং বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে সঞ্চয় অধিদপ্তরের বক্তব্য হলো, এর প্রভাব কী হবে, তা কিছুদিন পর বোঝা যাবে। আসলে সঞ্চয়পত্রের পেছনে সরকারকে প্রচুর টাকা সুদ দিতে হচ্ছে। মূলত সুদের এ বোঝাটা কমানোর জন্যই সরকার হয়তো এ পথে হেঁটেছে। তবে সরকারের চাওয়া হলো, যারা নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত তারা যেন বিনিয়োগ করেন। ধনীদের জন্য এ প্রকল্প নয়। এখানে শুধু যারা বেশি টাকা বিনিয়োগ করছেন তাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য লাভের অংশ কমানো হয়েছে। যারা কম বিনিয়োগ করবেন তাদের কমানো হয়নি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি যেভাবে বাড়ছিল তাতে সরকারের ওপর ক্রমেই চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। ব্যাংক খাতেও সুদের হার এখন কম। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। তবে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। তাদের কথা চিন্তা করে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান মুনাফার হার বজায় রাখতে পারে সরকার। তবে এখন সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানো যৌক্তিক এবং বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে বাকি ছিল বলে মনে করেন, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সালের পর সম্ভবত আর সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমেনি। এ বিশাল সময়ের মধ্যে দেশ-বিদেশের সব ইনস্ট্রুমেন্টের সুদহার কমেছে। বিনিয়োগ সহজতর হয়েছে। ফলে সরকারের ওপর বোঝা হয়ে থাকা এ সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোটা যৌক্তিক। দেশ-বিদেশের অন্যান্য বিনিয়োগ কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই সঞ্চয়পত্রে সুদের হার নির্ধারিত হওয়া উচিত। ডক্টর জাহিদ আরও বলেন, সঞ্চয়পত্রকে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য একটি ইনস্ট্রুমেন্ট বলা হলেও এখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নেই। মূলত সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরের পর বিপুল পরিমাণ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। কেউ আবার অলস টাকায় সঞ্চয়পত্র কিনে সরকারের ঋণ বাড়ান। ছয় বছর পর সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করেছে। এর আগে ২০১৫ সালে এক ধাপে কমানো হয়। বাংলাদেশে মোট ৬ ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ডাকঘর সঞ্চয়ের ব্যাংক-সাধারণ হিসাব ছাড়া সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন হারে মুনাফা নতুন সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ এ আদেশ জারি হওয়ার আগেই যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছেন তারা আগের হারেই মুনাফা পাবেন। শিল্প উদ্যোগ ও পুঁজিবাজারে বড় বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে প্রায় ৬ বছর পর সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুদহার কমিয়েছে সরকার। এখন থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি এবং নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে মুনাফা কম পাবেন গ্রাহকরা। নতুন সুদহারের আওতায়, যে কোনো সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়েছে। বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকা অতিক্রম করলে সুদহার প্রায় ২ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে সর্বোচ্চ ১০.৭৫ শতাংশ এবং ৩০ লাখ টাকায় সর্বোচ্চ ৯.৭৫ শতাংশ সুদ পাওয়া যাবে। এর আগে ২০১৫ সালে ১৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার ১১.৭৬ শতাংশ করা হয়েছিল। প্রজ্ঞাপনে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার পেনশনার সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-সাধারণ হিসাব, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক-মেয়াদি হিসাবসহ সবক্ষেত্রেই সুদহার কমেছে। সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ মতে, সঞ্চয়পত্রের উদ্দেশ্য হলো- বৃদ্ধ, নারী, পঙ্গুসহ বিশেষ শ্রেণির মানুষের স্বল্প পুঁজি থেকে একটা মুনাফা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সচ্ছল রাখা। অথচ দেশের সম্পদশালীদের একটি বড় অংশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে রাখছে। এই চক্রটি ভেঙে শিল্প ও শেয়ারবাজারের মতো জায়গায় বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন নিয়মের আওতায়, যারা পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন তারা মেয়াদ শেষে ১০.৩০ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। বিনিয়োগ ৩০ লাখের বেশি হলে প্রদত্ত মুনাফা ৯.৫ শতাংশ হবে। অন্যদিকে ৩ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগকারীদের প্রদত্ত সুদ কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আর এতে ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হবে ৯ শতাংশ হারে। তবে অবসরপ্রাপ্তরা পেনশনার সেভিংসে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগকারী হলে তাদের ১০.৭৫ শতাংশ সুদ দেওয়া হবে আর তাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখের বেশি হলে সুদহার হবে ৯.৭৫ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগকারী ১০.৫০ শতাংশ সুদ পাবেন। অন্যদিকে এতে ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীকে ৯.৫০ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া হবে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যারা এখন থেকে সঞ্চয়পত্র কিনবেন, তাদের ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত এসব সুদহার কার্যকর হবে। তাছাড়া আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর, একই অঙ্কের পুনর্বিনিয়োগের ওপর নতুন সুদহার আরোপিত হবে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রেই কার্যকর হচ্ছে নতুন নিয়ম। বর্তমানে তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত সুদহার ১১.০৪ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ১১.২৮ শতাংশ, একই মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১.৭৬ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১.৫২ শতাংশ। অন্যদিকে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে প্রদত্ত ৭.৫ শতাংশ সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।