বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফের সংগঠিত হচ্ছে 'নিষ্ক্রিয়' জঙ্গিরা

সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে হামলার ছক অনলাইনে চলছে কর্মী সংগ্রহ ও বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ একেকটি সেলে ১৫ থেকে ২০ জন কাজ করছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:১২

হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক পুরোপুরি ভেঙে দিলেও তাদের মূল শেকড় সমূলে উৎপাটন করতে পারেনি। এমনকি ওই সময় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিপুলসংখ্যক শীর্ষস্থানীয় নেতা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ চক্র এতদিন অনেকটা 'নিষ্ক্রিয়' থাকলেও সম্প্রতি তারা নানা কৌশলে নতুন করে কর্মীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকায়, জঙ্গিরা নাশকতার মিশন নিয়ে মাঠে নামার আগেই গোয়েন্দা জালে ধরা পড়ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, 'সামর্থ্য হারানো' ওইসব নিষ্ক্রিয় জঙ্গির নতুন করে সংগঠিত হওয়ার নেপথ্যে বিশেষ কোনো টার্গেট রয়েছে। তাদের অপতৎপরতা এখনই কঠোরভাবে প্রতিহত করা না গেলে, এ গোষ্ঠী ফের ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। যা দেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফের অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করবে। জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার মিশন ব্যর্থ করে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের জনগণকেও সজাগ থাকার পরামর্শ দেন তারা। গোয়েন্দারা জানান, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন জঙ্গি গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানিয়েছে, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা জঙ্গি নেতারা অনলাইনে তাদের পুরনো নেটওয়ার্ক চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা এবং এর আশপাশের জেলাগুলোতে নতুন করে ঘাঁটি গড়ার টার্গেটে রয়েছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ তৈরি এবং বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে অনলাইনে কর্মী সংগ্রহ কার্যক্রম চালানোও তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই তারা তাবলিগ জামাতসহ ধর্মীয় বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনাকারী মুসলিস্নদের সঙ্গে মিশে তাদের মিশন সফলের চেষ্টা করছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিরা আর্থিক সংকটে থাকায় লুট, ছিনতাই ও ডাকাতিতে নেমেছে। তারা এরই মধ্যে ডজনখানেক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ লুট করেছে। এমনকি তারা খুনের ঘটনাও ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনে বেরিয়ে তারা আবারও একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বোমা তৈরিতে পারদর্শী জঙ্গিরা ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও ডাকাতদলের সদস্যদের কাছে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক বিক্রি করছে। সম্প্রতি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ওর্ যাবের হাতে অন্তত ২০ জঙ্গি গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এআইইউবি'র একটি গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-৫৪২৪) পেট্রলবোমা হামলা চালানোর সময় জঙ্গি দেলোয়ারকে হাতেনাতে আটকের পর বেশকিছু ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে দেলোয়ার জানিয়েছে, সে আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য। অনলাইনে বিভিন্ন অডিও-ভিডিও দেখে ও শুনে সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে একজন বিদেশি নাগরিকের ওপর হামলার জন্য সে গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় গিয়েছিল। তার টার্গেট ছিল মার্কিন নাগরিক। এজন্য এআইইউবির গাড়ি দেখে এটাকে আমেরিকান মনে করে সে পেট্রলবোমা হামলা চালিয়েছিল। সারা বিশ্বে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন করার পরও বাংলাদেশের সরকার কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, এজন্য দেলোয়ার সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। এদিকে সম্প্রতি সিটিটিসি ইউনিট মিরপুর থেকে সাব্বির ওরফে বামসি বারেক এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে আরেক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করার পর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। এ দুই জঙ্গি গোয়েন্দাদের জানান, জেএমবির বোমা তৈরির সবচেয়ে দক্ষ কারিগর ভারতে গ্রেপ্তারের পর তার উত্তরসূরি হিসেবে মো. জাহিদ হাসান নামের এক যুবক এর হাল ধরেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে পড়ুয়া এ মেধাবী ছাত্র জঙ্গিদের অনলাইনে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। বিষয়টি স্বীকার করে সিটিটিসির প্রধান, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, বোমা তৈরিতে দক্ষ এক জঙ্গির ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। উগ্রপন্থিদের যেকোনো তৎপরতা রুখতে অনলাইন ও অফলাইনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জঙ্গি কর্মকান্ডের ওপর নজর রাখা একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত কয়েক বছরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের আরও দু-এক এলাকায় কয়েক দফায় পুলিশ চৌকিতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তবে হামলায় ব্যবহৃত বোমার যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে গোয়েন্দারা অনুমান করছিলেন, একই জায়গায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে জঙ্গিরা এসব হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়ে অনুসন্ধানের একপর্যায়ে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, ডেটনেটর ও সার্কিটযুক্ত এসব বোমা স্থানীয়ভাবে তৈরি। রসায়ন ভালো বোঝেন-এমন কেউ এসব বোমা তৈরির নেপথ্যের কারিগর। পরে নানাভাবে তথ্য সংগ্রহের পর নিশ্চিত হওয়া যায়, জাবির ছাত্র জাহিদ বোমা তৈরির মূল ব্যক্তি। গোয়েন্দারা তথ্য অনুসন্ধানে আরও জানতে পেরেছে, নব্য জেএমবির পলাতক শীর্ষ নেতা মাহাদি হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে জঙ্গিদের বোমা তৈরির এই দক্ষ কারিগরের। অনলাইনে ইদাত-১, ইদাত-২ ও ইদাত-৩ নামে সেল পরিচালনা করে সেখানে জঙ্গিদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন তিনি। একেকটি সেলে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য রয়েছে। অন্যদিকে, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জঙ্গি আদর্শে উদ্বুদ্ব করে প্রশিক্ষিত করে তুলতে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী প্রায় দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দারা এরই মধ্যে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ফেসবুক আইডির সন্ধান পেয়েছে। র্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বছিলার জঙ্গি আস্তানা থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি জেএমবি শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টারকে গ্রেপ্তার করের্ যাব। তিনি বছিলায় জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক থাকায় তার এ অপচেষ্টা ভেস্তে গেছে। এদিকে সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রহমত উলস্নাহ চৌধুরী সুমন জানান, গত ১০ আগস্ট গ্রেপ্তারকৃত বোমাগুরু ফোরকানসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ভিডিও দেখে তারা বোমা তৈরি করত। গোয়েন্দারা ওই ভিডিও এবং বোমা তৈরির প্রশিক্ষণদাতাদের যোগসূত্র খুঁজছে। র্ যাবের একটি সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পুরনো ধারার সদস্যদের একটা অংশ নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের একসময়কার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারের নেতৃত্বে এ অংশটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে সংগঠিত হচ্ছিল। সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের জন্য এ জঙ্গিরা ডাকাতির পরিকল্পনাও করছিল। এমনকি এক ডাকাতির প্রস্তুতিকালে সম্প্রতি ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র?্যাব। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বছিলা এলাকার একটি বাসা থেকে এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে গ্রেপ্তার করা হয়। র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমদাদুল হক নতুন করে সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি ২০০৩ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এলাকায় একটি ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ডাকাতি, নাশকতা, হত্যার অভিযোগে ঢাকা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় থাকা এ গ্রম্নপটির বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। \হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে