সাগরে ইলিশ খরায় সীতাকুন্ডের জেলেদের একরাশ হতাশা

প্রকাশ | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

সীতাকুন্ড (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
সন্দ্বীপ চ্যানেলের গভীর সমুদ্র থেকে ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে রোববার বিকালে কুমিরা ঘাটে ফেরেন বিপস্নব জলদাশ। ইলিশের আশায় দুইজন জেলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে গভীর সমুদ্রে গিয়েছিলেন তিনি। তবে মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। তাই একরাশ হতাশা নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন তিনি। আর খালি হাতে ফেরায় তার জন্য ঘাটে অপেক্ষারত স্বজনদেরও মুখের হাসি মস্নান হয়ে যায়। শুধু বিপস্নব জলদাশ নন, ইলিশের ভরা মৌসুমে খালি হাতে ঘরে ফেরেন মতিলাল, হরেন্দ্র, লক্ষণ, বাঞ্চারাম, নিমাই ও পবিত্র জলদাসসহ দশজন জেলে। নৌকাভর্তি ইলিশ মাছ ধরে রাজ্যের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায় তারা সাগরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইলিশের দেখা না পেয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছেন তারা। বিপস্নব জলদাস জানান, শনিবার দুপুরে দুজন জেলে নিয়ে ইলিশ ধরতে সাগরে গেলেও সামান্য ইলিশ আর বিপুল হতাশা নিয়ে ফিরেছেন তিনি। সাগর থেকে আনা ইলিশ পাইকারের কাছে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। তা দিয়ে পরিশোধ করেছেন দুই জেলের বেতন ও জ্বালানি তেলের দাম। তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনাকালে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরেন তিনি। ইলিশের মৌসুমে মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনে চারজন জেলে রাখেন তিনি। জেলেদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করাসহ ইলিশ মৌসুমে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এর বাইরে জাল, নৌকা, জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয় আরও দুই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ইলিশ মৌসুমে তার সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হলেও এখনো অর্ধলাখ টাকা উপার্জন করতে পারেননি। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যনুসারে, সীতাকুন্ডের জেলেরা সন্দ্বীপ চ্যানেলের সাগর থেকে ২০২০ সালে মৌসুমের শুরু থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ১২৫ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরেছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের একই সময়ে মাত্র ৩৭৩ মেট্রিক টন ইলিশ পেয়েছেন তারা। উত্তর চট্টলা উপকূলীয় মৎস্যজীবী জলদাস সমবায় কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি লিটন জলদাস জানান, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে সীতাকুন্ডের সৈয়দপুর পর্যন্ত সাগর উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করা ৫৩ হাজার জেলে পরিবার সাগরে মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইলিশ কম ধরা পড়ায় বিপাকে পড়েছে এসব জেলে পরিবার। অনেকে দেনা পরিশোধ করতেও পারেননি। আগামী 'জো'তে ইলিশ ধরতে পারলে ক্ষতি হয়তো কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতেন তারা। বিষয়টি বিবেচনায় নিতে মঙ্গলবার তারা স্মারকলিপি দেবেন। দেওয়ার পরও সরকার সিদ্ধান্ত বদল না করলে কঠোর কর্মসূচি দেবেন জেলেরা। জেলেরা জানান, তাদের বাৎসরিক আয়ের উৎস হলো ইলিশ মৌসুম। তবে পুঁজি না থাকায় মহাজন-আড়তদারের কাছ থেকে উপজেলার ৭৫ শতাংশ জেলে বিশেষ শর্তে ঋণ নেন। ঋণের টাকায় ইলিশ ধরার যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহ করে সমুদ্রে পাড়ি জমান তারা। সাগরে ইলিশ আহরণের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশোধের স্বপ্ন দেখলেও ইলিশ শূন্য হাতে ফিরে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন জেলেরা। এতে ভরা মৌসুমেও জেলে পরিবারগুলোতে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। উপজেলার কুমিরা জোরামতল, বাড়বকুন্ড, পৌরসদরের মোহন্তের হাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ছোট টুকরিতে করে ইলিশ বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম প্রতি কেজি ২৫০ টাকার বেশি। গত বছর এই আকারের ইলিশ খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছিল ৮০-১০০ টাকায়। ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়, ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬০০-৮০০ টাকায়। এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায়। তবে এ বছর বড় ইলিশ তেমন দেখা যাচ্ছে না। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামীম আহমেদ জানান, সন্দ্বীপ চ্যানেলে এবার ইলিশ কিছুটা কম ধরা পড়েছে। উজান থেকে মিঠাপানির সংকট ও শিল্প কারখানার বর্জ্যের কারণে এমনটা হয়েছে বলে তার ধারণা। সাগরের পানিতে ভাসমান বর্জ্য ও তেলের কারণে পানিতে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না। এতে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে এখানে আগের মতো ইলিশ পাওয়া যায় না।