সংলাপ সফল হওয়ার ইতিহাস এদেশে নেই

প্রকাশ | ৩১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

যাযাদি রিপোটর্
নানা নাটকীতার পর শেষ পযর্ন্ত সংলাপের দরজা খুলে যাওয়ায় দেশের সবর্স্তরের মানুষের দৃষ্টি এখন সংলাপের দিকে। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে বহুবার রাজনৈতিক সংলাপ হলেও সফলতার উদাহরণ নেই বললেই চলে। এবারও সংলাপ সফল হবে বলে রাজনৈতিক দলসহ বেশীরভাগ মানুষ আশা না করলেও শেষ পযর্ন্ত সংলাপ হচ্ছে, এতেই খুশি। সংলাপের আতীত ইতহাস পযাের্লাচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটময় মুহূতের্ সংলাপ হয়েছিল বিভিন্ন সময়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতার পটপরিবতর্ন হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৭৬ সালের ২২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সংলাপে বসার আহŸান জানিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গভবনে সাতদলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেন এরশাদ। তখন সাতদলের পক্ষ থেকে ৩৩ দফা দাবিনামা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, সেই সংলাপ ফলপ্রসূ না হওয়ায় সাতদলের নেতারা সংলাপকক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। পরদিন ১০ এপ্রিল বঙ্গভবনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন এরশাদ। ১১ এপ্রিল ১৫ দলের নেতাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এরশাদের সংলাপ হয়েছিল। এর একদিন পর ১২ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার একান্ত বৈঠক হয়। ১৪ এপ্রিল বঙ্গভবনে এরশাদের সঙ্গে ১৫ দলের দ্বিতীয় পযাের্য়র বৈঠক হয়েছিল। ২৮ এপ্রিল বঙ্গভবনে আবার আরও ১০ দলের সঙ্গে সংলাপ হয় এরশাদের। কিন্তু সেসব সংলাপ শেষ পযর্ন্ত কোনো ফল দেয়নি। এরপর ১৯৮৭ সালে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সংলাপের জন্য এরশাদ কয়েকদফা আহŸান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকদের কাছ থেকে সাড়া পাননি। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর আবারও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনিবার্চন নিয়ে বিতকর্ সৃষ্টি হওয়ার পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পাটির্ ও জামায়াতে ইসলামী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চন দাবি করে। সেবারই প্রথম তত্ত¡াবধায়ক সরকারের দাবি তোলা হয়। পরবতীের্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে ১৯৯৪ সালের ৩১ আগস্ট রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের দুই উপনেতার মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। এ ছাড়া ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বৈঠক হয়। উদ্যোগ নেয়া শুরু হয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার। তখনকার কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় এসে দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংলাপে দুই নেত্রী আনুষ্ঠানিক সম্মতিও দিয়েছিলেন। পরে সেটিও সফল হয়নি। এমেকা খুব একটা আশার আলো দেখতে না পেয়ে পরে তারই বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানকে পাঠিয়েছিলেন। যিনি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত¡াবধান ও পরিচালনা করেছিলেন। নিনিয়ান একটি রাজনৈতিক ফমুর্লাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ফমুর্লা তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মেনে না নেয়ায় সেই প্রচেষ্টাও ব্যথর্ হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে আবার বিরোধী দল সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই বছরের ১৮ ফেব্রæয়ারি বিরোধী দলের সেই সংলাপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তদানীন্তন শাসকদলীয় অন্যতম শীষের্নতা ও সংসদ উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নিবার্চনের দাবি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের তা প্রত্যাখ্যানের জেরে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সেটা নিরসনে বাংলাদেশে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কাটার্র। তিনি ফিরে যান ফলপ্রসূ কোনো ভ‚মিকা রাখতে না পেরে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভ‚ঁইয়া ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী সংলাপ হয়েছিল নিবার্চনকালীন সরকার ইস্যুতে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। ওই সময় মান্নান ভ‚ঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে ছয় দফা বৈঠক হলেও সমঝোতা হয়নি। ফলে দুইজনই তাদের দলের শীষের্নত্রীর কঁাধে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নিবার্চনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নিবার্চনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপি। সংকট নিরসনে জাতিসংঘের রাজনীতি-বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফানাের্ন্দজ তারানকো তিনবার ঢাকা সফর করেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ছয়দিন ঢাকায় অবস্থান করেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিজার্ ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে সরকার ও বিরোধী দলের প্রথম বৈঠকটি হয় ১০ ও ১১ ডিসেম্বর। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তারানকো। তৃতীয় বৈঠক হয় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উপস্থিতিতে। কিন্তু কোনো বৈঠকেই সমাধান আসেনি। স্বাধীনতার পর এ দেশে একটি সংলাপও সফল না হওয়ার পরও বিএনপি দীঘির্দন ধরে সংলাপের দাবি করে আসছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা এতে সাড়া দেয়নি। এবার ঐক্যফ্রন্টের শীষর্ নেতা ড. কামাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের আহŸান জানিয়ে চিঠি দেয়ার পর সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। সংলাপের আহŸান জানিয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছেন ফ্রন্টপ্রধান ড. কামাল হোসেন। জবাবে ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে মঙ্গলবার ড. কামালকে চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিগত সময় সংলাপ ব্যথর্ হলেও এবার ক্ষমতাসীনরা সংলাপে বসতে রাজি হওয়ায় অন্ধকারে আলো দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি অন্ধকার ঘরে ঢুকে আছে। এই সংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় সেই অন্ধকারে একটি আলোর রেখা পড়েছে। এটি ইতিবাচক দিক, তা স্পষ্ট। এর ফল হবে না হবেÑ সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু সংলাপ যে হচ্ছে, এটাই বড়। দীঘির্দন পর পরিণত রাজনীতির একটি সুস্পষ্ট প্রকাশ এই সংলাপ। সংলাপে একটি পক্ষের সব দাবি মানতে হবে তা যেমন নয়, আবার সব কিছু অস্বীকার করতে হবে, তাও নয়। একসঙ্গে বসার একটি সূচনা হচ্ছে, সেটা সামনের দিকে গেলেই রাজনীতির চেহারা পাল্টে যাবে।