শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমন্বয়হীনতার গেরোয় বাড়ছে যানজট

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৯:২৭
রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী যানজটের ভোগান্তি। প্রতিদিনই নগরীর সড়কজুড়ে থাকে তীব্র জট। ছবিগুলো গত বুধবার গুলিস্তান, রোববার নিউমার্কেট ও মঙ্গলবার বনানী এলাকার

তীব্র যানজটে ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে রাজধানী। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়ক, মোড় ও ট্রাফিক সিগন্যালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়ে মানুষ সীমাহীন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ কর্মজীবীর মূল্যবান শ্রমঘণ্টা; পুড়ছে যানবাহনের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা ধরনের খেসারত দিতে হচ্ছে। গত কয়েকদিনের ভ্যাপসা গরমে যানজটে দীর্ঘক্ষণ একই স্থানে যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকায় যাত্রীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, এ সংকট কাটাতে যানজটের প্রায় ডজন দুয়েক কারণ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও কার্যত সমাধানের উদ্যোগ খুবই কম। রাজধানীর যানজট বা ট্রাফিক সমস্যার প্রধান কারণ, সমস্যা সমাধানে সমন্বয়হীনতা। যে যার মতো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। ফলে তা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সহায়ক না হয়ে উল্টো যানজট সংকটের শক্ত গেরোয় পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের দাবি, রাজধানীতে যানজটের মূল কারণ ক্রটিপূর্ণ পরিবহণ ব্যবস্থা। এছাড়া প্রধান সড়কগুলোতে কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ এক সঙ্গে শুরু এবং গলিপথে মাসের পর মাস ধরে উন্নয়ন কাজের নামে ধারাবাহিক খোঁড়াখুঁড়ি; বিকল্প রাস্তার স্বল্পতা, সমন্বয়হীন রুট পারমিট প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচল, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা, সড়কের অপ্রশস্ততা, বাস-মিনিবাসসহ বিভিন্ন গণপরিবহণের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা, মাঝ রাস্তায় যানবাহন থামিয়েই যাত্রী ওঠানো-নামানো, যত্রতত্র যানবাহনের স্ট্যান্ড, রেলগেট এবং হিউম্যান হলারের মাত্রাধিক্য যানজটকে রীতিমতো স্থায়ী রূপ দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মার্কেটসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সামনে অপরিকল্পিত পার্কিং, ফুট ওভারব্রিজের অভাব ও তা ব্যবহারে পথচারীদের অনীহা, রাস্তাজুড়ে বড় বড় আবর্জনার কনটেইনার দুঃসহ যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি পার্কিংবিহীন বহুতল ভবন, ব্যারিয়ারবিহীন ভিআইপি রোড, অটো \হসিগন্যালের অভাব ও অব্যবহার, বিকল্পহীন ভিআইপি রোড, একমুখী রাস্তায় ডিভাইডার, যত্রতত্র হকার্স মার্কেট-কাঁচাবাজার গড়ে তোলাসহ ভাঙাচোরা রাস্তা যানজটকে আরও দীর্ঘায়িত করছে। করোনা মহামারির ঢেউ লাগার পর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি সর্বত্রই ভ্যানে পসরা সাজিয়ে হকারদের রাস্তা দখলের হিড়িক 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন রাস্তা ও ফ্লাইওভারের নির্মাণকৌশলে ত্রম্নটির কারণেও যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে ট্রাফিক পুলিশ বেশি তৎপর থাকায় পিক-আওয়ারের পাশাপাশি অফ পিক-আওয়ারে ব্যস্ত সড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিন নির্ধারিত সংখ্যক মামলা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জোরালো তাগিদ থাকায় ট্রাফিক সার্জেন্টরা সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন। তবে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দাবি, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে রাজধানীতে গাড়ির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ, ফিটনেসবিহীন ও কাগজপত্রে ত্রম্নটিজনিত গাড়ির সংখ্যা। করোনায় কর্মহীন হওয়া অনেকে ছোট-বড় যানবাহনের চালকের আসনে বসেছে। অদক্ষ এসব চালকের অনেকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। যা পথচারী ও পরিবহণ যাত্রীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কারণে ট্রাফিক সার্জেন্টদের এ ব্যাপারে নজর বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসার পর থেকে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়েছে। মানুষ জরুরি প্রয়োজনে বাসা থেকে বেশি বের হচ্ছে। আবার ঢাকার বাইরে থেকেও বিপুলসংখ্যক মানুষ আসছে। রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গাড়ি চলার কারণে ট্রাফিক নিয়ম বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক সার্জেন্টদের বেশি তৎপর থাকতে হচ্ছে। এতে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। প্রসঙ্গত, গত আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ট্রাফিক পুলিশ ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬২টি মামলা করেছে। এর মাধ্যমে ১৫২ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৩৮৭ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, রাজধানীর ৩৭টি পয়েন্টে ২৪টি কারণে হরহামেশা যানজট লেগেই থাকছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মগবাজার, উত্তরা, পলস্নবী, মিরপুর, প্রগতি সরণিসহ নগরীর ২১টি পয়েন্টে একযোগে নানা উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি কারণে যানবাহন চলাচলের গতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব পয়েন্টে ১০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগছে। কখনো এক ঘণ্টাও পেরিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, সোনারগাঁও-এফডিসি ও মহাখালীসহ ৯ পয়েন্টে রেলগেটের কারণে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ২৯টি রেলগেট পেরিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৮০টি ট্রেন চলাচল করে। গড়ে ২০ মিনিট অন্তর ট্রেন চলাচল করে থাকে। তবে পুলিশের হিসাবে প্রতি ১২ মিনিট অন্তর রেলগেট বন্ধ করা হয়। এতে যানবাহন আটকে পড়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফকিরাপুল মোড়ে গড়ে ওঠা আন্তঃজেলা বাস স্ট্যান্ডের কারণে নয়াপল্টন থেকে মতিঝিল এবং রাজউক ভবন থেকে শাহজাহানপুর মোড় পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় দিন-রাত যানজট লেগেই থাকে। অভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলাবাগান, কমলাপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী ও জয়কালী মন্দির এলাকায়। এসব স্থানে প্রধান রাস্তাজুড়ে দূরপালস্নার বাস দাঁড় করিয়ে স্ট্যান্ডে পরিণত করা হয়েছে। শাহবাগ জোনে পুরোদমে মেট্রোরেলের কাজ চলায় চার লেনের রাস্তা কোথাও কোথাও দুই লেন হয়ে পড়েছে। এতে এ জোনে প্রায়ই গাড়ির সারি দীর্ঘ হচ্ছে। এছাড়া বাকি পয়েন্টগুলোতে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে মূলত পার্কিংবিহীন বহুতল ভবন, ব্যারিয়ারবিহীন ভিআইপি রোড, অটো সিগন্যালের অভাব ও অব্যবহার, বিকল্পহীন ভিআইপি রোড, একমুখী রাস্তায় ডিভাইডার, যত্রতত্র হকার্স মার্কেট-কাঁচাবাজার গড়ে তোলাসহ বিবিধ কারণে। তবে নগর পরিকল্পনাবিদ ও গণপরিবহণ সংশ্লিষ্টরা জানান, যানজটের ডজন দুয়েক কারণ বিভিন্ন সময় সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হলেও তা নিরসনে সমন্বিতভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ট্রাফিক বিভাগ, সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি ও বিভিন্ন প্রশাসন যে যার মতো করে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এতে যানজট সংকট না কমে উল্টো তা বেড়েছে। এছাড়া ওয়াসা, বিদু্যৎ ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বিভাগ এবং সংস্থা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতেও কোনো সমন্বয় রক্ষা করছে না। যা যানজট নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক সারোয়ার জাহান মনে করেন, যানজট কমাতে হলে এর চিহ্নিত কারণগুলো সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যক্তিগত ছোট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে। এজন্য গণপরিবহণ বাড়ানো জরুরি। মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হলে যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করে এই নগর পরিকল্পনাবিদ অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গণপরিবহণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, তা না হলে ছোট গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়বে। ফলে যানজট নিরসনে তা তেমন কোনো ভূমিকাই রাখবে না। এদিকে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটির সাবেক চেয়ারম্যান এবং আন্তর্জাতিক ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহউদ্দিন বলেন, 'রাজধানীর যানজট বা ট্রাফিক সমস্যাটার প্রধান কারণ, সমস্যা সমাধানে সমন্বয়হীনতা। ঢাকায় যানজটের কারণ অনেক এবং তা সবার জানা। কিন্তু এই সংকট নিরসনে স্বল্পমেয়াদে কম খরচে কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অতীতে কাজ করেছি। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকার ফুটপাত যদি দখলমুক্ত করা যায় আর অবৈধ পার্কিং যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে যানজট উলেস্নখযোগ্যভাবে কমে আসবে। কিন্তু এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। ফুটপাত এবং সড়কেও এখন বাজার বসানো শুরু হয়েছে। যা যানজটের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাপ্তাহিক কর্মদিবসের চতুর্থ দিন বুধবার গুগল ম্যাপে ঢাকার রাজপথের স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে তথ্যপ্রযুক্তির প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, নগরীর বেশিভাগ রাস্তা ছিল যানবাহনে ঠাসা। সাধারণত দুপুরে যানজট কিছুটা কম থাকলেও বিকাল পেরিয়ে রাত পর্যন্ত নগরীর অধিকাংশ রাস্তায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি জমে থেকেছে। মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, টিকাটুলী মোড়, গুলিস্তান, জিপিও মোড়, পল্টন, কাকরাইল, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, এমনকি হাতিরঝিল এলাকার সড়কেও তীব্র যানজট দেখা গেছে। ভ্যাপসা গরমে এসব সড়কে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা গণপরিবহণ যাত্রীরা এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে