দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

সংসার চালানোই যেন দায়

পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ স্বাভাবিক। তারপরও কেন বাড়ছে দ্রব্যমূল্য- এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। করোনার কশাঘাত সামলে উঠতে মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'

প্রকাশ | ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০৪

আহমেদ তোফায়েল

মজিবুর রহমান। রাজধানীর মিরপুরে শাহ-আলীবাগে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার টাকা বেতন পান। তার মধ্যে ছয় হাজার টাকা ঘর ভাড়া আর চার হাজার টাকায় সংসার চালান তিনি। এর মধ্যে তিন হাজার টাকা চাল ডালসহ মাসের বাজার খরচ আর এক হাজার টাকা ছেলের লেখাপড়ার খরচ। কিন্তু এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এত বেশি যে, আর এ টাকায় সংসার চালানোই যেন দায় তার। মজিবুর বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছরে এক টাকাও বেতন বাড়েনি তার। তারপরও কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন। কিন্তু এখন চাল, তেল, চিনি, আটা, পেঁয়াজ সব কিছুর দাম বেশি। এমনকি মুরগি, ডিম এসবের দামও ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশি মুরগি কেনার সাহস পান না। কেনার মধ্যে শুধু ডিম আর ব্রয়লার মুরগি কিনতেন। এখন এটাও সম্ভব হচ্ছে না। তেল, চিনির দামও নাগালের বাইরে। বেতন বাড়ছে না, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম সবই বাড়ছে। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি আগের চেয়ে নিয়ন্ত্রণে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। পণ্যের উৎপাদন সরবরাহ সবই স্বাভাবিক। তারপরও কেন বাড়ছে দ্রব্যমূল্য- এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। করোনার কশাঘাত সামলে উঠতে মানুষ যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সবাইকে এখন সংসারের হিসাব করতে হচ্ছে নতুন করে। কাটছাঁট করেও যেন মিলছে না হিসাব। নিম্নবিত্তের আমিষের জোগানের বড় উৎস ডিম আর ব্রয়লার মুরগি। এখন এগুলোও যেন নাগালের বাইরে। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বাজার। এদিকে দ্রব্যমূল্যের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সুখবর নেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। সপ্তাহখানেক আগেও যে পেঁয়াজ মিলত ৫০ টাকা কেজিতে, তা এখন ৭০ টাকা। তেল ও চিনির দামও বাড়তি। বৃহস্পতিবার পেঁয়াজের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়ে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এছাড়া, চিনি ও তেলের ওপর থেকে অ্যাডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে, শুল্ক ছাড় দিলে এর সুবিধা ভোক্তারা পান না। ১৪৮ টাকার সয়াবিন তেল ১০ দিনের ব্যবধানে বেড়ে ১৫৮ টাকা। মোটা মসুরের ডাল ৭০ টাকা থেকে হয়েছে ৯০ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২০ টাকা। এছাড়া আটা, ময়দা ও আদা-রসুনসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে মানুষের করুণ অবস্থার কথা ফুটে উঠেছে। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) পরিচালিত জরিপে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে ৪২ শতাংশ হওয়ার কথা জানানো হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় জনসাধারণের বিপুল একটা অংশ যে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। টিসিবির পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, এক বছরের কিছু বেশি সময়ের চেয়ে মোটা চালের দাম ৩১ শতাংশ বেড়েছে। খোলা আটার দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। মসুরের দাম ৩০ শতাংশ, চিনির দাম ১৯ শতাংশ। অন্য দিকে তেলের দাম ৪৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত বছর ৫ লিটারের একটি সয়াবিন তেলের বোতল কেনা যেত ৫০০ টাকায়, এখন সেটা বেড়ে সাড়ে সাতশ' টাকা হয়ে গেছে। সবজি ও মাছ-গোশতের দামও ঊর্ধ্বমুখী। সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম হয়েছে ১৮০ টাকায়। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য পণ্যের দামও লাগামহীন বেড়ে যাচ্ছে। সাবান, টুথপেস্ট, নারকেল তেল ও টিসু্য পেপারের মতো জিনিসের দাম ২০ থেকে ৪০ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়েছে। এদিকে, টিসিবির ট্রাক থেকে সামান্য কিছু কম দামে পণ্য কেনার জন্য মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। সম্প্রতি এ লাইনের দৈর্ঘ্য আরও বাড়তে দেখা গেছে। যদিও টিসিবি অল্প কয়েকটি নিত্যপণ্য বিক্রি করে সাশ্রয়ী মূল্যে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আউটলেটের সংখ্যা কম। আবার সরকারের কাছ থেকে কম মূল্যে পণ্য কিনে অসাধু ডিলাররা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। উদ্বেগের মূল ব্যাপারটি হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষের বেকার হয়ে যাওয়া। আয়-রোজগার করা লোকদের বেতন কমে যাওয়া। তবে খাবারের দাম যে বেশি তা স্বীকার করেছেন কৃষিমন্ত্রী ডক্টর আব্দুর রাজ্জাক। শুক্রবার রাজধানীর খামারবাড়িতে বিশ্বখাদ্য দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, খাদ্যের জন্য দেশে এখন আর হাহাকার নেই, খাদ্য সংকট নেই, তবে খাবারের দাম একটু বেশি। কৃষিমন্ত্রী বলেন, খাদ্যের দামের বিষয়টা আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য স্থানীয় বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। চালের দাম একটু বেশি হলেও, চাল নিয়ে দেশে অস্থিরতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে সবচেয়ে লাগামহীন তেল আর চিনি। গেল সপ্তাহেই খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম সর্বোচ্চ ১৫৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়, যা দেশে ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে কেজি প্রতি ৭৪ টাকা। যদিও নির্ধারিত দামে তেল-চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীতে নিত্যপণ্যের সর্ববৃহৎ পাইকারি বাজার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ গোলাম মাওলা ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বৃদ্ধির পেছনে ভ্যাট-ট্যাক্স অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, প্রতি লিটার সয়াবিন ও পাম তেলের ভ্যাট ট্যাক্সের পরিমাণ ৩০ টাকার কম-বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি ও সয়াবিন উভয় পণ্যেরই দাম বাড়ছে। এর ওপর রয়েছে জাহাজ সংকট। ফলে ভাড়া বেড়েছে। এর সঙ্গে যদি প্রতি লিটারে ৩০ টাকা হারে ভ্যাট ট্যাক্স সরকারকে দিতে হয়, তাহলে দাম কীভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে? তিনি বলেন, শুধু তেল বা চিনি নয়, যেকোনো নিত্যপণ্যের আমদানি, সরবরাহ, মজুত এবং আন্তর্জাতিক বাজার দর সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়ার কোনো উপায় নেই। এসব প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের সরবরাহ, দাম ও মজুত ঠিক রাখতে পরিকল্পনা প্রয়োজন। তাই আগাম তথ্য না পেলে সেই পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। দেশে নিত্যপণ্য নিয়ে সরকারের ব্যবহার করা পরিসংখ্যান সঠিক নয় বলেও অভিযোগ গোলাম মাওলার। তিনি বলেন, তেল-চিনি ব্যবহারের পরিসংখ্যানে বড় ধরনের ঘাপলা রয়েছে। বর্তমানে আমরা যে পরিসংখ্যান ব্যবহার করি তা অনেক পুরনো। জনসাধারণ বাড়লেও পরিসংখ্যানে কোনো পরিবর্তন নেই। এটি কী করে সম্ভব! সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, চাল-ডাল, তেল-চিনিসহ নিত্যপণ্যের সরবরাহ, মজুত, দাম ঠিক রাখতে বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। সমন্বয়হীনতা নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করার জন্য দায়ী। তিনি তেল, চিনি, আটা, ময়দা উৎপাদনকারী কয়েকটি কোম্পানির নাম উলেস্নখ করে বলেন, এসব কোম্পানির মনোপলি সরকারের নজরে রাখতে হবে। কারণ, নিত্যপণ্যের বাজারে এ কোম্পানিগুলো বড় ফ্যাক্টর। এ চার-পাঁচটি কোম্পানি যদি আজ বলে- কাল থেকে চিনি, তেল, আটা, ময়দা তাদের নির্ধারিত দরে বিক্রি হবে, সেটিই কার্যকর হবে। এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। এদিকে, সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৭৫ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকার মধ্যে। গত সপ্তাহে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে এখন থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোয় এক দিনে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। বাজারে এখন সব থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে গাজর ও টমেটো। মান ভেদে এক কেজি গাজর ১০০ থেকে ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৪০ টাকায়। এ দুই সবজির পাশাপাশি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে অন্যান্য সবজি। শীতের আগাম সবজি শিম গত সপ্তাহের মতো কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা। ঝিঙের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ছোট ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। মুলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এ সবজিগুলোর দাম সপ্তাহের ব্যবধানে খুব একটা হেরফের হয়নি। এছাড়া চিচিঙ্গা, বরবটি, ঢঁ্যাড়স, পটোল, করলার দাম সপ্তাহের ব্যবধানে অপরিবর্তিত রয়েছে। করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ঢঁ্যাড়স ৪০ থেকে ৬০ টাকা, বরবটি ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কাঁচকলার হালি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, লালশাকের আঁটি ১০ থেকে ২০ টাকা, মুলাশাকের আঁটি ১৫ থেকে ২০ টাক, কলমিশাকের আঁটি ৫ থেকে ১০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর দাম সপ্তাহের ব্যবধানে অপরিবর্তিত রয়েছে। সবজির দামের বিষয়ে রামপুরার ব্যবসায়ী মো. জুয়েল বলেন, 'বাজারে সবজির অভাব নেই। কিন্তু আড়তে সব সবজির দাম চড়া। বেশি দামে সবজি কেনার কারণে আমরাও বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে দিন যত যাচ্ছে শিম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপির সরবরাহ বাড়ছে। তাই আশা করা যায় কিছুদিনের মধ্যে সবজির দাম কমে আসবে।'