শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
মন্দির ও পূজামন্ডপে হামলা

ইন্ধনদাতাদের ধরতে গোয়েন্দা জাল

উসকানিদাতা ও হামলাকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন সেজন্য দেশের সবক'টি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০৯:২৯

কুমিলস্নায় পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ তুলে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্ট ও বিভিন্ন জায়গায় পূজামন্ডপে হামলার নেপথ্যে একটি সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারী চক্রের ইন্ধন পেয়েছে তদন্তে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে ওই ঘটনায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি মদদদাতাদের চিহ্নিত করে দ্রম্নত আইনের আওতায় আনতে জাল পেতেছে গোয়েন্দারা। প্রায় এক ডজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নজরদারিতে রেখে তাদের গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কুমিলস্নার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এরইমধ্যে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয়াদি পর্যালোচনা করে শিগগিরই ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। তবে এ ফাঁকে তারা যাতে আত্মগোপনে কিংবা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে এ জন্য তাদেরকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মন্দিরে হামলায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশি তদন্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় সম্পৃক্তদের বিষয়ে বিশদ তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম উঠে এসেছে। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ইন্ধনও থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটানো সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর অভিযোগে দুইশ ফেসবুক অ্যাডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ। এদের কয়েকজনের ভয়েস বার্তাও পাওয়া গেছে। এতে হামলা চালানোর কথাও বলতে শোনা গেছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা। তারা জানান, তালিকাভুক্ত উসকানিদাতা ও হামলাকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন সেই জন্য দেশের সবকটি বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, পূজামন্ডপে হামলার ঘটনায় প্রশাসন কঠোর। যারা এই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বা উসকানি দিয়েছেন তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করছে। বিভিন্নস্থানে হামলার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। অসাম্প্রদায়িকতা নষ্ট করার জন্যই একটি মহল এসব অপকর্ম করেছে। তদন্ত করে শিগগিরই দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানায়, কুমিলস্নায় পূজামন্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনার জের ধরে গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ শনিবার রাতে ফেনীতে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই পর্যন্ত ৩৫টি পূজামন্ডপে হামলা করে মূর্তি ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এদিকে এ ঘটনার জের ধরে আগামীতে যাতে আর কোনো ধরনের হামলা-ভাঙচুর বা নাশকতার ঘটনা না ঘটে এজন্য সরকারের হাইকমান্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের ধরতে পুলিশের সবকটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের সবকটি রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও মেট্রো পুলিশ কমিশনাররা আলাদাভাবে বৈঠক করে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা পাঠান থানার ওসিদের কাছে। পাশাপাশি সবকটি গোয়েন্দা সংস্থাও দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, হামলার আশপাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিমা ভাঙচুরে যারা যারা অংশ নিয়েছিল তা ওইসব ফুটেজে ধরা পড়েছে। তাছাড়া আড়ালে থেকে যারা উসকানি দিয়েছেন তাদের বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের সংখ্যা শতাধিক। ইতোমধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতা রয়েছেন। পাশাপাশি শাসক দলের কিছু নেতা ইন্ধন দিয়েছেন অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। চাঁদপুর পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা জানান, বুধবার রাতে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ত্রিনয়নী সংঘ শ্রী শ্রী রাজলক্ষ্ণী নারায়ণ জিউর আখড়া পূজামন্ডপে হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই ফুটেজে দেখা গেছে- হামলাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। এদিকে চটগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের একটি মন্দিরে 'একশ থেকে দেড়শ' লোক হামলা চালায়। হামলাকারীরা একটি প্রতিমা ভেঙে ফেলে। তাছাড়া গন্ডামারা, বাংলাবাজার ব্রিজ, চান্দনাইশ, লোহাগড়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, পটিয়া এবং বোয়ালখালীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হামলা ভাঙচুর এবং বিক্ষোভ মিছিলের ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারের পেকুয়া কেন্দ্রীয় সার্বজনীন দুর্গামন্দির বিশ্বাসপাড়ায়ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩০০ থেকে ৪০০ দুষ্কৃতকারী হামলা করে মন্দিরের প্রধান গেট ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এসব দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে তারা এরইমধ্যে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে। এসব তথ্য যাচাইবাছাই করে দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হবে। র্ যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামন্ডপে হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। এদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হামলা ও সংঘাতের ঘটনার নেপথ্যে থেকে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুল তথ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে ২শ অ্যাডমিনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। আশা করি দ্রম্নত সময়ের মধ্যেই সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। আমাদের পাশাপাশি সিআইডিসহ আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা এসব ঘটনার তদন্ত করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে