করোনার মধ্যেও ছয় কারণে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা

মোট অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে পুঞ্জীভূত হ টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও হচ্ছে না হ ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে প্রশ্ন করা হচ্ছে না হ প্রবাসী আয়ের বড় অংশ ব্যাংকে জমা হ পুঁজিবাজার থেকে আয়ের একটা অংশ ব্যাংকে জমা হ প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত

প্রকাশ | ১৯ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২১, ০৯:২১

আহমেদ তোফায়েল

দীর্ঘদিন করোনা মহামারির কারণে দেশের অর্থনীতিতে নানা প্রভাব পড়লেও কোটিপতিদের ব্যাংক হিসাব দিন দিন বাড়ছে। করোনা সংক্রমণে মানুষের আয় কমলেও কমেনি কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক জুন শেষে কোটিপতির হিসাব গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বেড়েছে ১৬ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের মোট অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে পুঞ্জীভূত থাকা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হওয়া, ব্যাংকে যেকোনো পরিমাণ অর্থ জমা রাখলে প্রশ্ন না করা, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ব্যাংকে জমা থাকা, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল থাকা ও এ খাতের আয় ব্যাংকে জমা থাকা এবং প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা- এই ছয় কারণে কোভিডের সময়েও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ার এ হার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, করোনা অতিমারিতে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিবরা হচ্ছে আরও গরিব। এটি দেশে বৈষম্য বাড়ার বহিঃপ্রকাশ। তাদের মতে, অর্থনীতিতে যখন কোনো সংকট বিদ্যমান, আয়ের পথ সংকুচিত হয়, তখন এক শ্রেণির মানুষের হাতে অর্থবিত্ত বেড়ে যাওয়া সুখের লক্ষণ নয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, সমাজে বৈষম্য ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে কোটিপতির সবাই যে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করেছে তা নয়। এসব অর্থের উৎস খুঁজে দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, মহামারির বছরেও কোটিপতির সংখ্যা বাড়ার এ পরিসংখ্যান সমাজে বেড়ে চলা বৈষম্যের চিত্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ দেশের মোট অর্থ মুষ্টিমেয় কিছু লোকের কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ডক্টর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি মানে টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। এ টাকাগুলোই ব্যাংকে আসছে আমানত হিসেবে। এর ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা আরও বেশি।' এছাড়া, চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো ব্যাংকে যেকোনো পরিমাণ অর্থ জমা রাখলেও কোনো প্রশ্ন করা হবে না, এমন বিধান রাখা হয়েছে। এর প্রভাবেও কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়ে থাকতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'করোনার মধ্যেও প্রবাসী আয় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স পুরোটা খরচ না হয়ে ব্যাংকে জমা থাকছে বা টাকাটা অর্থনীতির মধ্যেই থাকছে।' তিনি বলেন, 'বর্তমানে পুঁজিবাজারও বেশ স্থিতিশীল। এ খাতে অনেকের বিনিয়োগ থাকায় সেখান থেকেও আয় হচ্ছে, যা অনেকে ব্যাংকে রাখছেন। আবার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নেওয়া ঋণের একটা অংশও ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখা হতে পারে। কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভালো নয় বলেও মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।' চলতি বছরের মে মাসে এক অনুষ্ঠানে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ হাজার লোক নতুন করে কোটিপতি হচ্ছে বলে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য কীভাবে বাড়ছে, আমাদের কতটা নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে। এ সময় বর্তমানে বাংলাদেশে বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ দিতে গিয়ে ফরাসউদ্দিন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, 'দেশে এখন মোট ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে ৪৩ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসাবে আছে মোট আমানতের ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ মোট আমানতের অর্ধেকই আছে এ ৪৩ হাজার মানুষের কাছে। বাকি ১ কোটি ১৯ লাখ ৫৭ হাজার ব্যাংক গ্রাহকের হাতে আছে বাকি অর্ধেক আমানত। এতেই বোঝা যায়, কীভাবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, কীভাবে বৈষম্য বাড়ছে। এমনটা চলতে থাকলে কখনই এ দেশ থেকে বৈষম্য দূর করা যাবে না। এ বিষয়টি সরকারকেই গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।' জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'বাংলাদেশে ধনিক শ্রেণির বৃদ্ধির হার বিশ্বে সর্বোচ্চ, একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের হারও সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে বৃহৎ প্রকল্পগুলোর নির্মাণব্যয় বিশ্বে সর্বোচ্চ; কারণ এর মধ্যে আছে ভয়াবহ দুর্নীতি, যেটা সম্ভব হয় জবাবদিহির অভাবে।' বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, জুন শেষে দেশে কোটিপতি হিসাব ৯৯ হাজার ৯১৮-এ উন্নীত হয়, যেখানে গত বছরের জুন শেষে কোটিপতি হিসাব ছিল ৮৬ হাজার ৩৭টি। তার মানে, এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ১৩ হাজার ৮৮১টি। প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাংক খাতে ৫ হাজার ৬৪৬টি কোটিপতি হিসাব যোগ হয়েছে, যেখানে বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কোটিপতি হিসাব বেড়েছিল ৩৮২টি। এছাড়া জানুয়ারিতে ব্যাংকে কোটিপতি হিসাব ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। মার্চ শেষে কোটিপতি হিসাব বেড়ে ৯৪ হাজার ২৭২-এ উন্নীত হয়। তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, করোনাভাইরাস মহামারি দেখা দেওয়ার পরও গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ১০ হাজার ৫১টি নতুন কোটিপতি ব্যাংক হিসাব যোগ হয়। কোটিপতি হিসাবগুলোতে আমানত যোগ হয় ৬৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। কোটিপতি হিসাব সংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ বাড়তে থাকায় মোট আমানতে কোটিপতিদের অবদানও বাড়ছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে মোট আমানতে কোটিপতিদের অবদান ছিল ৪৪ দশমিক ০৮ শতাংশ। জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে খোলা সব ধরনের হিসাবগুলোতে জমা ছিল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার। এ হিসাবগুলোর শূন্য দশমিক ০৮ শতাংশ হিসাব কোটিপতিদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি ২০২১ সালের জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব ছিল ৭৮ হাজার ৬৯৪টি। পাঁচ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১১ হাজার ১৩টি। ১০ কোটি টাকা থেকে ১৫ কোটি টাকা জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ৩ হাজার ৫৯৯টি। ১৫ কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১ হাজার ৭৩২টি। ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত জমা থাকা ব্যাংক হিসাব ছিল ১ হাজার ১৮৫টি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ জন, যা ১৯৭৫ সালে ৪৭ জনে উন্নীত হয়। দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল ৯৮ জন, ১৯৯০ সালে ৯৪৩ জন, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ জন, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ জন এবং ২০০৮ সালে ১৯ হাজার ১৬৩ জন।