শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ জেলায় বাড়তি সতর্কতা

সাখাওয়াত হোসেন
  ২০ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

দেশের ২৪ জেলায় নতুন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে যেকোনো অপ্রীতিকর ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত বিশেষ বার্তা এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটালে কিংবা সংখ্যালঘুদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়ালে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আগাম হুঁশিয়ার করা হয়েছে।

পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, কুমিলস্নায় পূজামন্ডপে পবিত্র ধর্মগ্রন্থকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিবাদের জের ধরে তৃতীয় একটি পক্ষ দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জায়গায় পূজামন্ডপে হামলার পর সর্বশেষ রোববার রাতে রংপুরে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। নতুন করে এ ধরনের হামলার আশঙ্কা না থাকলেও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভীতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জেলাগুলোতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অস্বস্তিতে রয়েছেন। অজানা ভয়ে সেখানে অনেকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। এসব বিষয়াদি সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দেশের ২৪ জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের নেতাকর্মী এবং মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখার তাগিদ রয়েছে। যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা কোনো ধরনের ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো মাত্র তাকে আইনের আওতায় আনা যায়। এছাড়া ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা অন্য কোনোভাবে কেউ যাতে কোনো গুজব ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করতে পারে সে ব্যাপারেও পুলিশের সাইবার ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে।

অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টের জন্য কোনো বিশেষ চক্র বা গোষ্ঠী যাতে নতুন করে ভীতি ছড়াতে না পারে এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নজরদারি বাড়াচ্ছে গোয়েন্দারা। যাতে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা তৈরি করার সময়ই তাদের দ্রম্নত আইনের আওতায় আনা যায়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ দিন এ বাড়তি সতর্কতা চলমান থাকবে। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে ধাপে ধাপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি কমিয়ে আনা হবে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক অনুমেয় না হলে বিশেষ সতর্কতার মেয়াদ আরও বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে পঞ্চগড় জেলার পুলিশ সুপার মো. ইউসুফ আলী জানান, পুলিশ পুরো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে।

কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে না পারে সেজন্য প্রতিটি থানাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।

একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের তথ্যানুযায়ী, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা তত বেশি অপতৎপরতা শুরু করেছে। সম্প্রতি জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার

পর তাদের কাছ থেকে দেশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির বিভিন্ন পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে গত বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, স্থাপনা ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭১টি মামলা হয়েছে। আরও কিছু মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সোমবার রাত পর্যন্ত এসব মামলায় ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান। তিনি জানান, এসব ঘটনায় জড়িত বিপুলসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এখনো পলাতক রয়েছে। তাদের ধরতে বিভিন্ন জেলায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক পোস্ট ও ভিডিও ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে এসব সাইবার অপরাধীদেরও একটি বিশাল তালিকা তৈরি করের্ যাব-পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযানে নেমেছে।

এদিকে রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্ধশত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও আতঙ্ক কাটেনি সেখানকার বাসিন্দাদের। বড় করিমপুরের এলাকাবাসী পুলিশকে জানায়, চোখের সামনে চেনা মুখগুলো এসে পেট্রোল ঢেলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হাতে-পায়ে ধরেও তাদের এ কাজ বন্ধ করা যায়নি। ঘরে ঢুকে টাকা, স্বর্ণ, গরু, ছাগল লুট করে নিয়ে গেছে। তবে তারা পুলিশের কাছে হামলাকারীদের নাম স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছে।

কুমিলস্নাতেও হিন্দু অধু্যষিত এলাকাগুলোতেও অনেকটা একই ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে যে পূজামন্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন শরীফ উদ্ধার করা হয়েছে, ওই এলাকার সংখ্যালঘু অনেক পরিবার এখন বিনিদ্র রজনী পার করছেন। তাদের ভাষ্য, সন্দেহভাজন অনেক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও এ ঘটনার মূল ইন্ধনদাতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই যেকোনো সময় আবারও সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বস্তি পাচ্ছেন না।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, কুমিলস্নার মন্ডপে যিনি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, যে ঘটনার কারণে এতকিছু, তিনি শিগগিরই ধরা পড়বেন। তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন, তাই ধরা পড়ছেন না। তবে বেশিদিন তিনি পালিয়ে থাকতে পারবেন না বলে আশা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

আসাদুজ্জামান খান কামাল পীরগঞ্জের ঘটনা প্রসঙ্গে জানান, পরিতোষ নামে এক তরুণ ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বাড়ি পুলিশ পাহারা দিয়েছে। তার বাড়িতে হামলা হয়নি, তার পাশের গ্রামে হামলা হয়েছে। গোয়েন্দারা হামলাকারীদের শনাক্ত করেছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

এদিকে ষড়যন্ত্রকারী কোনো চক্র যাতে নতুন করে কোনো হামলার ঘটনা ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে এজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। খোদ দলীয় সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকেও এ ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।

সাম্প্রতিক ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ যখন বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক সে সময়ে একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিতভাবে দেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সরকার ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করেছে। ইতিমধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে এবং বাকিদেরও আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সরকার পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে এবং এই ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে