একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চন

টিপু মুনশির আসনে দুই ভরসা

রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা)

প্রকাশ | ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

কাউনিয়া (রংপুর) সংবাদদাতা
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে রংপুর-৪ (কাউনিয়া ও পীরগাছা) আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রাথীর্ এবং জাতীয় পাটির্ ও বিএনপির নবাগত শিল্পপতি প্রাথীর্রা ভোটযুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রাথীর্রাও বসে নেই। প্রাথীর্রা সারা দিন নিবার্চনী মাঠঘাটে গণসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন। আর রাতে ফোনে ফোনে দলের ত্যাগী ও বষীর্য়ান নেতাদের খেঁাজখবর নিচ্ছেন। কাউনিয়ার একটি পৌরসভা, ছয়টি ইউনিয়ন ও পীরগাছার নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১২ হাজার ৬৬৮ জন। নিবার্চনী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এ আসনে জয়লাভ করেন আ’লীগের প্রয়াত আব্দুল আউয়াল এমপি। ১৯৭৯ সালে জয়লাভ করেন বিএনপির শিল্পপতি রহিম উদ্দিন ভরসা এমপি। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি নিবার্চনেও জয়লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে জয়লাভ করেন আ’লীগের প্রয়াত ভাষাসৈনিক শাহ আব্দুর রাজ্জাক এমপি। ১৯৮৮ ও ১৯৯১ সালে জয়লাভ করেন জাতীয় পাটির্র শিল্পপতি শাহ আলম এমপি। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জয়লাভ করেন জাতীয় পাটির্র শিল্পপতি করিম উদ্দিন ভরসা এমপি। আর ২০০৮ সালে জাপার প্রাথীের্ক পরাজিত করে বিজয়ী হন আ’লীগের শিল্পপতি টিপু মুনশি এমপি। ২০১৪ সালের নিবার্চনেও তিনি জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নিবার্চনে এ আসনে আওয়ামী লীগ জয়ের মুখ দেখে। দীঘর্ ২২ বছর পর সংসদ সদস্য নিবাির্চত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অথর্ ও পরিকল্পনা-বিষয়ক সম্পাদক টিপু মুনশি। এই শিল্পপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পকির্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিরও সভাপতি। এ আসনে আওয়ামী লীগের অন্য কোনো প্রাথীর্ না থাকায় আসন্ন নিবার্চনে তিনি আবারও নৌকার মাঝি হবেন বলে নিশ্চিত রয়েছেন। রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান তুহিন চৌধুরী বলেন, ‘উন্নয়ন মানে নৌকা আর নৌকা মানে টিপু মুনশি’। তিনি দুইবার সাংসদ নিবাির্চত হয়ে দুই উপজেলায় যে উন্নয়ন করেছেন, তা বিগত কোনো সাংসদই করতে পারেননি। এ কারণে এলাকার ভোটারের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ টিপু মুনশি। কাউনিয়া উপজেলা আ’লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম ও সম্পাদক আব্দুল হান্নানসহ তৃণমূল নেতাকমীর্রা বলেন, সফল এমপির নেতৃত্বের প্রতি তারা আস্থাশীল। এ আসনে টিপু মুনশির বিকল্প নেই। সাংসদ টিপু মুনশি যায়যায়দিনকে বলেন, গত ১০ বছরে দুই উপজেলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ, অবকাঠামো, দারিদ্র্যবিমোচন, বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অনেক উন্নয়নমূলক কাজ চলমান রয়েছে। তিনি পরপর দুই দফায় এমপি নিবাির্চত হয়ে নিঃস্বাথর্ভাবে মানুষের পাশে থেকেছেন। তিনি দলমত নিবিের্শষে সবার মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করেছেন বলে তার বিশ্বাস। হতদরিদ্র মানুষদের কাজ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে এ আসনে পাঠিয়েছেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন এই দুই উপজেলাকে আধুনিক ও মডেল উপজেলা গড়বেন। সেই পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছেন। একাদশ নিবার্চনে জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। লাঙ্গলের হাল ধরতে চায় নবাগত দুই কাÐারি ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত এ আসনটি জাপার দখলে ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে নিবার্চনে আসনটি হাত ছাড়া হয়ে যায়। এবার সাবেক সাংসদ করিম উদ্দিন ভরসার ছেলে জাপার মনোনয়নপ্রাথীর্ যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম ভরসা এ আসনটি পনুরুদ্ধার করতে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, তিনি বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। এ আসনটি পনুরুদ্ধার করতে তৃণমূলের সব নেতাকমীর্ই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যোগ্য প্রাথীর্র ক্ষেত্রে দল তাকেই মনোনয়ন দেবেন এমন দাবি তার। দল তাকে মনোনয়ন দিলে আসন্ন নিবার্চনে জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী তিনি। জাতীয় পাটির্র আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সদ্য যুবলীগ থেকে জাতীয় পাটিের্ত যোগ দেয়া শিল্পপতি মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, দীঘর্ সময় থেকে এলাকার মানুষের সঙ্গে তার সম্পকর্। জনগণ তাকে ভালোবাসেন। তাই জনপ্রিয়তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পাটির্র হাইকমান্ড তাকে মনোনয়ন দেবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। জাপার হারাগাছ পৌর শাখার যুগ্ম-সম্পাদক সেরেকুল ইসলাম বলেন, সাবেক সাংসদের পুত্র শিল্পপতি সিরাজুল ইসলাম ভরসা নবাগত হলেও তিনি দীঘির্দন ধরে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তার মনোনয়ন চাওয়ার সঙ্গে সাধারণ ভোটারদের চাওয়ার একটা মিল রয়েছে। তিনি দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দীঘির্দন থেকে ব্যক্তিগতভাবে অসহায় মানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা, ফ্রি চিকিৎসা সেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণসহ ধমীর্য় প্রতিষ্ঠানে অনুদান প্রদান করে আসছেন। নীরব ভোটে ধানের শীষে আশাবাদী তিন প্রাথীর্ এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা আগে থেকে নড়বড়ে। তার ওপর ২০১৪ সালের নিবার্চনের পর মামলা-হামলা, গ্রেপ্তার-হয়রানিসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় এখনো নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণার মাঠে নামতে সাহস না পেলেও নীরব ভোটে নিরঙ্কুশ জয়ের আশা করছেন দলের নেতারা। দলের একাধিক নেতা বলেন, তফসিল ঘোষণার আগে তারা নিবার্চনী প্রচার-প্রচারণায় নামলে প্রাথীর্ ও নেতাকমীের্দর ওপর নানা ধরনের হয়রানি-নিযার্তনের খড়গ নেমে আসতে পারে। তাদের দাবি, নিবার্চনের মাঠে প্রাথীর্রা সোচ্চার না হলেও তারা গোপনে নিবার্চনী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিরপেক্ষ-নীরব ভোটারদের সিংহভাগই তাদের পাশে রয়েছেন। আসন্ন নিবার্চনে এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সাংসদ রহিম উদ্দিন ভরসার পুত্র ও বতর্মানে কাউনিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি শিল্পপতি এমদাদুল হক ভরসা। তিনি ২০০৬ থেকে উপজেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তবে নবাগত তরুণ এ নেতা মামলা-হামলা ও হয়রানির ভয়ে রাজনীতির মাঠে না থাকায় তৃণমুল নেতাকমীের্দর মন জয় করতে পারেননি। এছাড়া দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী জাতীয়তাবাদী পেশাজীবী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসিির্টর সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ড. শাহেদ কামাল পাটোয়ারী এবং জেলা বিএনপির সহসভাপতি কনের্ল (অব.) আব্দুল বাতেন। তাদের মাঠে দলীয় কাযর্ক্রম নেই। এমদাদুল হক ভরসা যায়যায়দিনকে বলেন, এ আসনে বিএনপির নেতাকমীর্রা আগের চাইতে অনেক উজ্জীবিত। সেই সঙ্গে তার বাবা সাবেক এমপি রহিম উদ্দিন ভরসার পরিচিতি দানবীর হিসেবে এখনো উজ্জ্বল। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নিবার্চন হলে এ আসনে তার বিজয় নিশ্চিত। বিএনপি কাউনিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে শক্ত অবস্থানে শিল্পপতি এমদাদুল হক ভরসা। আগামী একাদশ জাতীয় নিবার্চন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি সহজে জয়লাভ করবে। বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী ড. শাহেদ কামাল পাটোয়ারী যায়যায়দিনকে বলেন, ছাত্র থাকাবস্থায় থেকে রাজনীতি করে আসছেন। দল তাকে মনোনয়ন দিলে আশা করেন বিজয়ী হবেন ইনশাআল্লাহ। অপরদিকে মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি কনের্ল (অব.) আব্দুল বাতেনের একাধিক সমথর্করা জানান, তিনি দলের দুদিের্ন গুরুত্ব¡পূণর্ ভূমিকা রেখেছেন। এবারের নিবার্চনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমন শতভাগ আশার কথাই জানিয়েছেন তার সমথর্করা। তবে মনোনয়ন চাওয়ার ব্যাপারে কনের্ল (অব.) আব্দুল বাতেনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এ আসনে মনোনয়ন পাচ্ছেন যুক্তফ্রন্টের (জাসদ-রব) প্রাথীর্ হিসেবে পীরগাছা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওয়াজেদ আলী সরকার। তিনি ইতোমধ্যে এলাকায় নিবার্চনী গণসংযোগ শুরু করেছেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী মুহাম্মাদ বদিউজ্জামান দুই উপজেলার সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিয়ম করছেন। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির জন্য নীতির পরিবতের্নর মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে তাকে ভোট দিয়ে নিবাির্চত করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দলকে সরকার গঠনে এগিয়ে আসবে ভোটাররা। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. শরিফুল ইসলাম নিজেকে দলীয় প্রাথীর্ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার জাতীয় পাটির্ ও বিএনপির প্রাথীর্রা হলেন নবাগত। তারা পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন। তাদের মাঠের রাজনীতিতে উপস্থিতি কম থাকায় তারা এখনো তৃণমূল নেতাকমীর্ কিংবা সাধারণ ভোটারদের কাছে নিজেদের ইমেজ সেভাবে তৈরি করতে পারেনি। তবে জাপার বষীর্য়ান নেতা করিম উদ্দিন ভরসা বা বিএনপির বষীর্য়ান নেতা রহিম উদ্দিন ভরসা প্রাথীর্ হলে সে ক্ষেত্রে আসনটি ধরে রাখতে ঘাম ঝরাতে হতো আওয়ামী লীগের প্রাথীের্ক। কারণ এ আসনে বিএনপি ও জাতীয় পাটির্র সাবেক দুই সাংসদই প্রভাবশালী এবং দুই উপজেলায় তাদের অনেক অবদানও রয়েছে। তবে এ আসনে আওয়ামীলীগ, জাতীয় পাটির্ ও বিএনপির মধ্যেই প্রতিদ্ব›িদ্বতা হবে। কারণ তিন দলের প্রাথীর্রা হচ্ছেন শিল্পপতি। এ আসনে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে সুবিধা করতে পারবে না। জেলা নিবার্চন অফিস সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের নিবার্চনে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮০৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন টিপু মুনশি (আ.লীগ)। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী: করিম উদ্দিন ভরসা (জাপা) ভোট পায় ১ লাখ ৩ হাজার ৬৪৩ ও তৃতীয় স্থানে ছিল বিএনপির রহিম উদ্দিন ভরসা, প্রাপ্ত ভোট : ৬৩ হাজার ৯৯৯। অপরদিকে ২০১৪ সালের নিবার্চনে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮২ ভোট পেয়ে টিপু মুনশি (আ.লীগ) বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী জাপার করিম উদ্দিন ভরসা, ভোট পান ৯ হাজার ৯৮৬।