শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দানবীয় চলনে ময়লাবাহী গাড়ি!

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩৩

তদারকি না থাকায় সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি নিয়ম ভেঙে অসময়ে রাজধানীর রাস্তায় দানবের মতো দাপিয়ে বেড়ায়। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক এসব গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে উল্টো পথে কিংবা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালেও হয়রানির ভয়ে ট্রাফিক পুলিশ তাদের বাধা দিতে ভয় পায়। এ সুযোগে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠায় বর্জ্যবাহী এসব যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে একের পর এক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ঘটনাতেই ঘাতক চালকরা আইনের ফাঁক-ফোকর গলে অনায়াসেই পার পেয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ময়লাবাহী গাড়িগুলো রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত চলাচলে হাইকোর্টের নির্দেশ থাকলেও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তা মানছে না। অধিকাংশ ময়লাভর্তি গাড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ময়লা বহনে ঢাকনাযুক্ত গাড়ি ব্যবহারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা থোড়াই কেয়ার করছে। সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় হতাহতের সঠিক সংখ্যা কোনো সংস্থার কাছে না থাকলেও এ তালিকা বেশ দীর্ঘ বলে জানিয়েছে ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ ও থানা পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালের দেওয়া তথ্যেও এর সত্যতা মিলেছে। তবে হতাহতের এসব ঘটনায় অভিযুক্ত গাড়িচালকদের অন্য বিভাগে বদলি ছাড়া আইনগত শাস্তি পাওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ডিএমপি সূত্র জানায়, বুধবার গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হওয়ার পরদিনই বসুন্ধরা সিটির সামনের রাস্তায় উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আহসান কবীর খান নামে প্রথম আলোর এক সাবেক কর্মী। এর আগে ৯ আগস্ট রাতে শ্যামপুরের ধোলাইপাড় সাবান ফ্যাক্টরি গলি এলাকার রাস্তায় বেপরোয়া গতির ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় ফারুক হোসেন নামের এক রিকশাচালক নিহত হন। এ সময় আরও এক ভ্যানচালক গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ২ মে রাজধানীর শাহজাহানপুর টিটিপাড়ায় ময়লার ট্রাক চাপায় স্বপন আহমেদ দীপু নামে এক ব্যাংক কর্মচারীর মৃতু্য হয়। ১৬ এপ্রিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় মোস্তফা নামের এক রিকশাচালক মারা যান। এই ঘটনায় গুরুতর আহত হন রিকশা আরোহী সত্তরোর্ধ্ব হরেন্দ্র দাস। ওইদিন ঘটনার পরপরই স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা ময়লাবাহী গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে ১৭ জানুয়ারি গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ডিএসসিসি'র ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের স্টাফ খালিদ নিহত হন। এর আগে মিরপুরে ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় আবদুল খালেক হাওলাদার নামে একজন ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা এবং বংশালে নুরজাহান বেগমের মৃতু্য হয়। এর বাইরে সবুজবাগের মুগদা, বাসাবো, শনির আখড়া, ডেমরা, রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, নাখালপাড়া, তেজগাঁও, মনিপুরিপাড়া, গুলিস্তান, পুরান ঢাকার নর্থ সাউথ রোড, ওয়ারী, শ্যামপুর, উত্তরা ও পলস্নবীসহ প্রায় দুই ডজন এলাকায় বেপরোয়া গতির ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন বলে রাজধানীর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দুর্ঘটনাতেই সিটি করপোরেশনের অদক্ষ চালকদের তেমন কোনো শাস্তি হয়নি। তবে ডিএসসিসির পরিবহণ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের তিনটি দুর্ঘটনার তদন্ত করছে। একজন চালক জেলে আছে। ডিএসসিসি'র তথ্যানুযায়ী, ডিএসসিসিতে মোট যানবাহন আছে ৫১৩টি। এর মধ্যে ১৫০টি গাড়ি নিবন্ধিত। আর নগর সংস্থাটির নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৪৭। ২০০ গাড়ি চলে মাস্টার রোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। বাকি ১৬৬টি গাড়ি কীভাবে চলে তার সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি ডিএসসিসির পরিবহণ খাত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধিত চালক ছাড়া ডিএসসিসির বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। কখনো কখনো আবার ক্লিনাররাও এসব ভারী যানবাহন চালাচ্ছেন। ট্রাফিক পুলিশ এসব যানবাহন চালকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলে তারা রাস্তার মধ্যে ময়লাভর্তি গাড়ি রেখে সরে পড়ছে। এতে একদিকে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ময়লার গন্ধে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। ফলে এসব গাড়ি ও চালকের বিরুদ্ধে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিতে অনিহা দেখাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব গাড়ির কাগজপত্র সবসময় অফিসে থাকে। ট্রাফিক পুলিশ এসব গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করেন না। তাই কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না। এসব যানবাহনের বেশিরভাগই ত্রম্নটিপূর্ণ বলে স্বীকার করেন তারা। মাঠ পর্যায়ের একাধিক ট্রাফিক কর্মকর্তা জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়লাবাহী গাড়ি চলাচল করায় নানা ধরনের ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকনাবিহীন বর্জ্যবাহী গাড়ি নগরীর বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন। তারা এ নিয়ে দফায় দফায় সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে সিটি করপোরেশন বলছে, রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত নগরীতে পরিবহণের আধিক্য থাকা এবং ঢাকনাযুক্ত ট্রাকের স্বল্পতার কারণে নির্দিষ্ট সময় বর্জ্য অপসারণ করতে পারছে না। এ বিষয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন সহকারী প্রকৌশলী বলেন, হাইকোর্টে নিয়ম মেনে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হচ্ছে। কিন্তু সময়মতো বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রাত ১০টার পরে রাজধানীতে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ঢোকে। বিভিন্ন সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ময়লা অপসারণ সম্ভব হয় না। এছাড়া যানবাহনের স্বল্পতা রয়েছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, নির্ধারিত সময়ে ময়লা অপসারণ করতে না পারার বিষয়টি হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ময়লা অপসারণের সময় রাত ১২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত করার আবেদন করেছে। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, দুই সিটি করপোরেশনে ৪২২টি ময়লার কনটেইনার রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণে ৩৭০ এবং উত্তরে ৫২টি আবর্জনার কনটেইনার রয়েছে। আর এর জন্য পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছে দক্ষিণে ৫ হাজার ২৩৯ জন এবং উত্তরে ৩ হাজার ১২৬ জন। প্রতিদিন গড়ে দক্ষিণে ২৫০০ টন ও উত্তরে ২৭০০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এছাড়া দক্ষিণে বর্জ্য পরিবহণের গাড়ি রয়েছে ৩১২টি। এর মধ্যে খোলা ট্রাক ১৫০, কাভার্ড ট্রাক ৬ ও আধুনিক কম্পেক্টর ৩২টি। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ উলস্নাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে ঢাকার বর্জ্য অপসারণ করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ময়লা অপসারণে ঢাকনাযুক্ত গাড়ি ব্যবহারও করতে বলা হয়। হাইকোর্ট নির্দেশনা দেওয়ার পর ওইদিনেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র বর্জ্য অপসারণে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করার ঘোষণা দেন। সংশ্লিষ্টরা নিয়ম না মানলে তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে