আন্দোলনে দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশের শঙ্কা

যেসব জেলায় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ওইসব জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা আগাম তথ্য সংগ্রহে মাঠে নেমেছে

প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩৩

সাখাওয়াত হোসেন

গণপরিবহণে হাফ পাস নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ সড়ক আইন বাস্তবায়ন ও ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগসহ ১০ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন সহসা আরও বেগবান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এ সুযোগে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে দুর্বৃত্তদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। এমনকি আন্দোলনের নামে তারা চোরাগোপ্তা হামলা কিংবা নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে সে দায় শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শিক্ষার্থীরা তাদের নৈতিক দাবি আদায়ে রাজপথে নামলেও বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের ভিন্ন পথে পরিচালনার পাঁয়তারা করছে বলে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য পেয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সংশ্লিষ্টরা একাধিক প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সারা দেশে পুলিশকে সতর্ক করে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি আন্দোলন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে তাদের কোনো কর্মসূচিতে বহিরাগত দুষ্কৃতকারীরা মিশে গিয়ে কোনো অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা চালায় কিনা সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ নজরদারি বাড়ানোর জন্য প্রতিটি থানা ও মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাগিদ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। সরকারের দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের নিম্নমুখী হওয়ায় দীর্ঘদিন পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরপরই আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মিশন নিয়ে মাঠে নামে সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রকারীরা। এরই মধ্যে গণপরিবহণে হাফ পাস ও সড়ক দুর্ঘটনায় নটর ডেম কলেজের ছাত্রের মৃতু্যকে ঘিরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামায় এ ইসু্যকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রকারী চক্র তাদের ঘৃণ্য স্বার্থ সিদ্ধির অপচেষ্টা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কড়া নজরদারিতে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নেপথ্য নায়কদের চিহ্নিত করে তাদের গতিবিধিরও নজরদারির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে সারা দেশে এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব জেলায় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ওইসব জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চসহ (এসবি) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ ব্যাপারে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালে তা যাতে শক্ত হাতে তাৎক্ষণিক দমন করা যায় সে ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তুত রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের প্রথম সারির নেতাদের উপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের গতিবিধি কঠোরভাবে নজরদারি করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা মাঠে কাজ করছে। সূত্রটি জানায়, গোয়েন্দারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পৃথক তালিকা তৈরি করছে। একই সঙ্গে তাদের প্রিভিয়াস ক্রাইম রেকর্ড (পিসিআর) খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিগত সময় ছাত্র আন্দোলনের নামে সংঘটিত বিভিন্ন নৈরাজ্যকর ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল, তা-ও সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করছেন গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে তারা সর্বোচ্চ সজাগ রয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা ও ক্যাডার- যারা বিভিন্ন সময় নানা নৈরাজ্যকর ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের তালিকা হাতে নিয়ে এরই মধ্যে নজরদারির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও তিতুমীর কলেজসহ এক ডজন কলেজের শিক্ষার্থীদের সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বেপরোয়া গতির গাড়ি চাপায় রেডিসন হোটেলের উল্টো দিকে, কুর্মিটোলা ফ্লাইওভারের ঢালে শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। এ ঘটনার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৩০ জুলাই কুর্মিটোলা ফ্লাইওভারের ঢালে শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে যানবাহন ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা মিরপুর সড়ক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কসহ বেশ কিছু সড়ক অবরোধ করে। ৩১ জুলাই সরকারি বিজ্ঞান কলেজ ও তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থীরা ফার্মগেট সড়ক, ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে। এছাড়া আরও অন্তত এক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বেশ কয়েকটি সড়ক দীর্ঘ সময় অবরোধ করে রাখে। এদিন হিমাচল, এনা ও বুশরা পরিবহণের তিনটি বাসে আগুন দেয় শিক্ষার্থীরা। মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। যাত্রাবাড়ীতে সড়ক অবরোধ ও বাস ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ২ আগস্ট মিরপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। এরপর ৪ আগস্ট জিগাতলায় কিশোর ছাত্রছাত্রীদের উপর বহিরাগত দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। এদিন রাত সাড়ে আটটা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফেসবুক লাইভে মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার অভিযোগে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে আটক করা হয়। ফার্মগেটে হেলমেট পরে দুর্বৃত্তরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ৫ আগস্ট ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ ও অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। এ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর রাজপথ আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সুযোগে একদল বহিরাগত দুর্বৃত্ত এসব আন্দোলনে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন ধরনের তান্ডব চালানোর চেষ্টা করে। মালিবাগ আবুল হোটেলের সামনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে গাড়ি ভাংচুরের সময় কয়েকজন দুর্বৃত্তকে আটক করা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তারা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরে নাশকতায় অংশ নিলেও ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী নয়। এছাড়া যাত্রাবাড়ীতেও কলেজের ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকজন অছাত্র দুষ্কৃতকারীকে আটক করে শিক্ষার্থীরা। গোয়েন্দারা জানান, ২০১৮ সালের মতো এবারের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনও একই দিকে মোড় নিতে পারে। তাই সে সময়ের মতো এবারও নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা ফন্দি আঁটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তারা। এ প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় যায়যায়দিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময়ই সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচির উপর গোয়েন্দা নজরদারি করে থাকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। এছাড়া শিক্ষার্থী আন্দোলনের ইসু্যতে কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে এজন্য ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে।