ভোটের হাওয়ায় ভয়ের বার্তা

প্রকাশ | ২৮ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২১, ০৯:২১

সাখাওয়াত হোসেন

প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষে ৪০ জন নিহত এবং দুই হাজার ৫৪৩ জন আহত হন। বিপুলসংখ্যক ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতিতে তৃতীয় ধাপের নির্বাচন ঘিরে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেও ভোটকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণায় রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতা থামানো যায়নি। ফলে তৃতীয় ধাপে আজকের এক হাজার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে ঘিরে ভোটের হাওয়ায় ভাসছে ভয়ের বার্তা, যা সাধারণ ভোটারদের ভোটবিমুখ করে তুলতে পারে। বিশেষ করে নারী ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারাতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা বন্ধে গত ১৯ নভেম্বর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথচ ৪৮ ঘণ্টা পার না হতেই ২১ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জে নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নিহত ও ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। এর দু'দিনের মাথায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ইউপি নির্বাচনে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতায় একজন নিহত হন। এ ঘটনায় পরদিন বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ফুলবাড়ী-নাগেশ্বরী সড়কের বটতলা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন। নির্বাচনী সহিংসতায় ২৬ নভেম্বর ভোলায় এক যুবলীগ নেতা এবং টাঙ্গাইলের নাগরপুরে আওয়ামী লীগের এক কর্মী খুন হন। একই দিন নির্বাচনী সহিংসতায় আহত শরীয়তপুর সদর উপজেলায় এক কর্মী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় ভোলায় খোরশেদ আলম টিটু নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হন।

এছাড়া লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জে তিন চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, কুমিলস্নার বরুড়ায় এক স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় নৌকার প্রার্থীর চার কর্মী এবং হবিগঞ্জে দুই মেম্বার প্রার্থীর ১৫ জন সমর্থক আহত হন। সরিষাবাড়ীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে প্রতিপক্ষরা।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা জানান, তৃতীয় ধাপের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায়

সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। খুনোখুনি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের বেশিরভাগ নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধের জের ধরে। তবে বেশকিছু জায়গায় নৌকা প্রতীকের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজনের ওপরও হামলা চালিয়েছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, এসব সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা নির্বাচনকেন্দ্রিক হলেও মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে ঘটেছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীরা ভোটে নিরঙ্কুশ জয় লাভের জন্য এসব সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়েছে বলে মনে করেন তারা।

এদিকে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ঘোষণা দিলেও তাদের 'কথার ফাঁক' ভোটারদের আরও বেশি ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন ভোটকেন্দ্রের সহিংসতা ঠেকানোর কথা বললেও এর বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলে আগাম জানান দিয়েছে। অথচ প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনকেন্দ্রিক খুনোখুনি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের বেশিরভাগ ঘটনাই ভোটকেন্দ্রের বাইরে ঘটেছে। এ অবস্থায় ভোটাররা ভোটদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাদের ভাষ্য, ভোটকেন্দ্র নিরাপদ থাকলেও ভোট দিতে যাওয়ার পথে এবং সেখান থেকে ফেরার পথে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কেউ নেই। এছাড়া গত দুই ধাপে দেশের যেসব ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, এর বেশিরভাগ এলাকাতেই নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর তৃতীয় ধাপের প্রচার-প্রচারণা চলাকালীন সংঘাত-সহিংসতায় ভোটারদের মধ্যে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা ভোটারদের বক্তব্যে স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

মুন্সীগঞ্জের চরকেওয়ার ইউনিয়নের ভোটার আব্দুলস্নাহ আল মামুন এ প্রতিবেদককে জানান, 'ভোট দিতে যাবো কি না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছি।'

একই ইউনিয়নের ভোটার শহীদুল ইসলাম জানান, তিনি নিজে ভোট দিতে গেলেও স্ত্রী-কন্যা ও পুত্রবধূ কাউকে কেন্দ্রে যেতে দিবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। কেননা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বিভিন্ন ইউপিতে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জের এই ইউনিয়নেও ২১ নভেম্বর একজন নিহত এবং ৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নের ভোটার নাসরীন লাকী। পেশায় চাকরিজীবী এই ভোটার বলেন, 'ভোটার হিসেবে নিজের ভোটটা দেওয়ার উৎসাহ ছিল। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকেই যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলা ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে, তা দেখে আতঙ্কে আছি। ভোট দিতে গিয়ে পাছে কোনো বিপদের মুখোমুখি হতে হয়, আশঙ্কায় কেন্দ্রে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

নাসরীন লাকী আরও বলেন, 'ভোটের মাঠে পরিস্থিতি যেভাবে আকস্মিক ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তাতে পরিবারের পুরুষ অভিভাবকরা নারীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।'

এদিকে নির্বাচন কমিশন সহিংসতা থামাতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ইসি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় বেশকিছু ব্যবস্থা নিলেও ভোটারদের আসা-যাওয়ার পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এছাড়া নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাও ততটা জোরালো নয়।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার একজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, ভোট দেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর লোকজনের সামনে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট দিতে হয়েছে। এবারও বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা চেয়ারম্যান পদে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। এর বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেকে ভোটদানে আগ্রহ হারিয়েছেন।