শুরুতেই হোঁচট খেল নগর পরিবহণ

বাস মালিকদের অসহযোগিতায় ১ ডিসেম্বর থেকে চালু হচ্ছে না ঘাটারচর-কাঁচপুর পর্যন্ত পাইলট প্রকল্প

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০৯:১৭

আব্দুলস্নাহ রায়হান

রাজধানীর গণপরিবহণ ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা থেকে যাত্রীদের স্বস্তি ও আরামদায়ক যাত্রা নিশ্চিতে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে আলাদা একটি কোম্পানির অধীনে ১০০টি বাস নিয়ে চালু হওয়ার কথা ছিল নগর পরিবহণ নামে বিশেষ বাস সার্ভিস। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহণ মালিকদের অসহযোগিতার কারণে যাত্রা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে নগর পরিবহণ। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত প্রায় ২১ কিলোমিটারের এ রুটে যাতায়াত ভাড়া ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার দুই টাকা ২০ পয়সা। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

সূত্র জানায়, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি জানিয়েছিল পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ডিসেম্বর থেকেই বাস চলবে পাইলট প্রকল্পে। ২০১৮ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের 'বাস রুট রেশনালাইজেশন' কমিটি গঠন করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর মধ্যে গত তিন বছরে প্রকল্পের গতি শুধু কাগজে কলমেই সীমাব্ধ থাকতে দেখা গেছে।

সূত্র জানায়, পুরো রাজধানীতেই বাস রুট রেশনালাইজেশন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মাধ্যমে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনাও কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ ছিল। এই তিন বছরে সড়কে শৃঙ্খলা যেমন ফেরেনি তেমনি সড়ক দুর্ঘটনা এবং সড়কে প্রাণহানিও কমেনি। জানা যায়, 'ঢাকা নগর পরিবহণ' হতে পারে যানজট নিরসনে কমিটির পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ। বর্তমানে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন ডিএসসিসি বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

বাস রুট রেশনালাইজেশন সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে সময়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবেদনে ঢাকার ২১৯টি রুটের পরিবর্তে ৪২টি রুট

পরিচালনার কথা বলা হয়েছিল। এসব রুটে ২২ কোম্পানি বাস পরিচালনা করবে বলেও নির্দেশনা দেওয়া ছিল। রাজধানীতে চলাচলকারী ২ হাজার ৫০০ বাসের কোম্পানি রয়েছে। এই রুটে কোনো পুরনো বাস থাকবে না বলেও বলা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারির আগে কেনা কোনো বাস চলতে পারবে না বলে নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়েরও।

সূত্র জানায়, রাজধানীর গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নতুন চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি মারা যাওয়ার পর দায়িত্ব বর্তায় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের ওপর। এরপর তার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১১টি সভা করলেও প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। পরে সাঈদ খোকনের জায়গায় দায়িত্ব পান বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমতিতে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি 'ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের' কাজ শুরু করে। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩১৯ কোটি ২৩ লাখ সাত হাজার টাকা। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের সময় নির্ধারণ হয়। প্রকল্পের মধ্যে নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৫০টি নতুন যাত্রী ছাউনি নির্মাণ, বিদ্যমান ৪৭টি পদচারী-সেতু সংস্কার, ট্রাফিক সাইন স্থাপন, সড়কে মিডিয়ান নির্মাণ ও ফুটপাত উন্নয়নের কথা ছিল। তবে প্রকল্পের কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখনো চোখে পড়েনি। এছাড়া ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে পুরনো বাস উঠিয়ে নতুন বাস নামানোরও কথা ছিল। পরিবহণ মালিকরা এই রুটে বাস চালানোর জন্য সম্মতিও দিয়েছিলেন।

এদিকে, পরিবহণ মালিকদের অসহযোগিতার কারণে বিআরটিসির ৩০টি দোতলা বাস দিয়ে নগর পরিবহণ রুটটি শুরু করবে। এর সঙ্গে আরও ৭০টি বাসের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। যে কেউ চাইলে এই রুটে নিয়ম মেনে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়িও নামাতে পারবেন। এজন্য ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটির কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে।

রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা বাস্তবায়নে গত এক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন ছিল। আমরা লক্ষ্য পূরণের কাছাকাছি ছিলাম। ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর একটি পাইলটিং রুট নির্ধারণ করেছিলাম। এ রুটে নতুন নিয়ম এবং পদ্ধতিতে বাস চলবে। সবার প্রচেষ্টায় আমরা এতদূর আসতে পেরেছি।

তিনি বলেন, আগামী ১ ডিসেম্বর এ রুটে বাস চলাচল শুরুর কথা চূড়ান্ত ছিল। কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে বাসগুলো জয়েনভেঞ্চারের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। তবে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে আমরা চূড়ান্ত তারিখ পিছিয়েছি। আগামী ২৬ ডিসেম্বর আমরা এই প্রকল্পের আলোর মুখ দেখব বলে আশা করছি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকায় গণপরিবহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করার লক্ষ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি কাজ করছে। তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা আসবে। চালকের মাঝে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকবে না। ফলে দুর্ঘটনাও কমে যাবে।

১ ডিসেম্বর নগর পরিবহণ চালু না হওয়ার কারণে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ইচ্ছের কোনো ত্রম্নটি ছিল না। বাস মালিকরা আমাদের যেভাবে প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন তারা সেই কথা রাখতে পারেনি। তাই আমরা বিআরটিসির বেশ কিছু বাস নিয়ে আগামী ১ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৬ ডিসেম্বর এই রুট চালু করব। এছাড়া আগামী ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে যদি কোনো পরিবহণ আমাদের কাছে এই রুটে চলার জন্য আবেদন করে তাহলে আমরা সেসব বাস নেব। বিআরটিসির পক্ষ থেকে এই রুটে ৩০টি দোতলা বাস দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বাস মালিকদের অসহযোগিতা প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ যায়যায়দিনকে বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন ও পরিবহণ মালিকদের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক সাহেবের সময় থেকে এই রুট চালুর কথা বলা হয়েছে। আমরা তখন থেকেই সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে পাশে থেকেছি।

তিনি বলেন, ২১ কিলোমিটারের ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর রুটে পাইলট প্রকল্প হিসেবে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে যে বাস আমরা নামাতে চেয়েছিলাম তার ১২০টি গাড়ির ২০১৯ সাল পর্যন্ত রুট পারমিট ছিল না। আমরা বাস মালিকদের প্রস্তুত করেছিলাম সেইসব গাড়ি চালাতে। সভায় সিদ্ধান্ত ছিল যে ৪২০টি গাড়ি যারা রুট পারমিটের জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদের ছাড়া আর কাউকে দেওয়া হবে না। তবে রুট পারমিট না থাকা ৪২০টি গাড়ির মধ্য থেকে ১২০টি গাড়ি নিতে বললে কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। তারা বলছেন, কমিটির যে সিদ্ধান্ত ছিল এ সিদ্ধান্তের বাইরে তারা কিছু করবেন না। যার ফলে ১ ডিসেম্বরে বাস মালিকদের বাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখানে আমাদের অসহযোগিতার কোনো কারণ আছে বলে আমি মনে করি না।